Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 4:00 am

নিয়োগ পরীক্ষায় ফেল করা প্রার্থী এখন কুবির রাঘব

কুবি প্রতিনিধি: কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) নথি জালিয়াতি, একাধিক শিক্ষককে মারতে তেড়ে যাওয়া, সহকর্মী ও কর্মচারীদের সাথে অসদাচরণ, হেনস্তা ও গালমন্দ, জামাত-শিবির ট্যাগ লাগিয়ে হয়রানি, বিভিন্ন নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্যের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে ডেপুটি রেজিস্ট্রার জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে। তিনি ২০১৩ সালে কর্মকর্তা নিয়োগ পরিক্ষায় ফেল করা প্রার্থী এখন কুবির রাঘব। তার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ থাকার পরও প্রশাসনের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জাকিরের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও বেপরোয়া ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাদের অভিযোগ, এই কর্মকর্তার বেপরোয়া আচরণে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় দিনদিন অশান্ত হয়ে উঠেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পূর্বেও একাধিক শিক্ষককে হেনস্তা ও লাঞ্ছিত করতে ঔদ্ধত্য হয়ে এগিয়ে যান এই কর্মকর্তা। গত ২০১৪ সালে নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আবদুর রহমানকে শারীরিক ভাবে লাঞ্ছিত করেন।

এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হলে বিষয়টি পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১ তম সিন্ডিকেটে উঠে। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভবিষ্যতে বেপরোয়া আচরণ করলে চাকরিচ্যুতিসহ জাকিরের বিরুদ্ধে যেকোনো সিদ্ধান্ত প্রশাসন নিতে পারবে বলে জানা যায়। ২০২২ সালে জাকিরের দ্বারা ইংরেজি বিভাগের আরেক শিক্ষক অপমানিত ও হেনস্তা করেন। একই বছরের রেজিস্ট্রারের কক্ষে তালা দিয়ে তৎকালীন রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. আবু তাহেরকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি উপাচার্যের কক্ষে শিক্ষকদের থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে ফেলে দেওয়ার হুমকি প্রদান করেন।

এদিকে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বলেন, তিনি পূর্বেও একাধিক শিক্ষককে হেনস্তা করেছেন। সিন্ডিকেটে তার বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তও রয়েছে। তিনি যদি ভবিষ্যতে অশালীন আচরণ করেন তাহলে চাকরিচ্যুতিসহ যেকোনো সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিতে পারবে। আমরা আজ শিক্ষকদের গণস্বাক্ষর গ্রহণ করব এবং উপাচার্যের নিকট সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে লিখিত দিব। আমরা চাই, উপাচার্যের কক্ষে শিক্ষকদের সাথে যে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছে তার সুষ্ঠু তদন্ত হোক এবং এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হোক।

নৃবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক আইনুল হক বলেন, পূর্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা জাকির হোসেন এক শিক্ষকের সাথে অশোভন আচরণের জন্য একটি শোকজ লেটার পেয়েছিলেন। উপাচার্যের কক্ষে তিনি শিক্ষকদের সাথে যে আচরণ করেছেন তা কোনো শুধু শিক্ষকের সাথেই নয়, এমন আচরণ কোনো শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কারো সাথে হওয়া উচিত না। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

জানা যায়, জাকির ২০১৩ সালে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পায়। অভিযোগ রয়েছে, তিনি নিয়োগ পরীক্ষায় ফেল করা প্রার্থী ছিলেন। নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই স্থানীয় ক্ষমতা দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাব বিস্তার করে একে একে সবার সাথেই অসদাচরণ শুরু করেন। জাকির নিজেকে কখনো সাবেক অর্থমন্ত্রীর অনুসারী, কখনো সাবেক রেলমন্ত্রীর অনুসারী, আবার কখনো কুমিল্লা সদর আসনের এমপি হাজী বাহারের অনুসারী বলে পরিচয় দিয়ে প্রভাবে বিস্তার করেন। এভাবে প্রভাব বিস্তার করে সাবেক উপাচার্য আলী আশরাফের সময়ে জাকির তার দুবাই ফেরত ভাই বিল্লালকে উপ-সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। গুঞ্জন রয়েছে জাকির তার বড় বোনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ প্রদানের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন।

কর্মকর্তা জাকির বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার হয়েও বিলাসবহুল জীবন-যাপন করেন। হয়েছেন তিনি কুমিল্লা ক্লাবের সদস্য। এই ক্লাবের সদস্য হতে গেলে কমপক্ষে ২০ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। এছাড়াও নিজের পাজেরো গাড়িতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা যাওয়া করেন। কুমিল্লা ও ঢাকা মিলিয়ে জাকির বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাটের মালিক। কুমিল্লায় নিজের কেনা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে জীবন-যাপন করেন।

জানা যায়, জাকির পূর্বে সার্টিফিকেট বাণিজ্যের সাথেও জড়িত ছিলেন। তার পার্শ্ববর্তী গ্রামে “কাশিপুর টেকনিক্যাল কলেজ” নামে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে সার্টিফিকেট বাণিজ্য করতো। দৃশ্যতো কোন কলেজ ছিলো না, কুমিল্লা মহিলা কলেজের সামনে একটি অফিস নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতো। পরবর্তীতে বিষয়টি প্রকাশ পেলে জাকির সার্টিফিকেট বিক্রির বাণিজ্য বন্ধ করে দেন। অভিযোগ রয়েছে, জাকির বিশ্ববিদ্যালয়ের দাপ্তরিক কাজ নিয়মিত করেন না। দাপ্তরিক সময়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বিভিন্ন দপ্তরে দপ্তরে ঘুরে বেড়ান টেন্ডার বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। টেন্ডার হাতিয়ে নিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে হাতবদল করেন তিনি।

এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রয়েছে নথি জালিয়াতিরও অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তারা কোন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা লাভজনক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থাকতে পারবেন না। তবে সেই নির্দেশনা লঙ্গন করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নথি জালিয়াতি করে ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টাসহ নানা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অভিযোগ অভিযোগ রয়েছে।

সরকারি চাকরি করার ফলে জাকির সরাসরি কোন প্রতিষ্ঠানের মালিকানা গ্রহণ না করলেও তার বউ ও মেয়ের নামে একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তার বড় ভাই হুমায়ূন কবির সংক্ষেপে এইচ কবীর এন্টারপ্রাইজের সাথে মিলিত হয়ে বেশ কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিকানার সাথে তিনি যুক্ত রয়েছেন। তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান গুলো হলো ল্যান্ডমার্ক পলিটেকনিক ইনস্টিিটউট, ল্যান্ডমার্ক প্যারা-মেডিক ইনস্টিটিউট, কুমিল্লা কৃষি প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, লালমাই পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, কাশিপুর টেকনিক্যাল এন্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ।

এছাড়াও গেল বছরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স এসোসিয়েশনের নির্বাচনে তিনি সভাপতি পদে নির্বাচন করেন। অভিযোগ রয়েছে, নির্বাচনের আগে জাকিরকে ভোট দেওয়ার জন্য ভোটারদের নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করেন এবং ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে শপথ করান। একাধিক ভোটার বিষয়টি প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেন। এসব বিষয়ে জানতে ডেপুটি রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ জাকির হোসেনকে ফোন দেওয়া হয়। তিনি সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে ফোন রেখে দেন। পরবর্তীতে প্রতিবেদক আবার ফোন দিলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে উপাচার্য ড এ এফ এম আব্দুল মঈনকে কয়েকবার ফোন দেওয়া হলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সৈয়দুর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উপর যে হামলা হয়েছে সেখানে কর্মকর্তা জাকির, নাকি দেলোয়ার সেটা বড় বিষয় না। বরং উপাচার্যের কার্যালয়ে শিক্ষকদের হুমকি দেওয়ার সাহস তারা কোথায় থেকে পায়! সেটা প্রশাসনের ইন্ধনেই হয়েছে। শিক্ষক সমিতি যে পদক্ষেপ নিবে সেটা তার প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।