রহমত রহমান: হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেশের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর। দেশের প্রায় ৫২ শতাংশ আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ওঠানামা করে এ বিমানবন্দর দিয়ে। আর যাতায়াত করেন বছরে প্রায় ৪০ লাখ আন্তর্জাতিক ও ১০ লাখ অভ্যন্তরীণ যাত্রী। এ বিমানবন্দরের যাত্রী হয়রানি আর চোরাচালান নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রায়ই প্রশ্ন তোলা হয়। বিমানবন্দরের ভেতরে রয়েছে কয়েকটি কারেন্সি এক্সচেঞ্জ স্টল, যা নিরাপত্তার জন্য হুমকি। অভ্যন্তরীণ যাত্রীকে তল্লাশি না করায় বাড়ছে চোরাচালান।
এছাড়া বিমানবন্দরটিতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে যাত্রী। তাই একটি কাস্টমস হলের কারণে কাক্সিক্ষত সেবা নিশ্চিত ও রোধ হচ্ছে না চোরাচালান। পাশাপাশি স্টাফ গেট ও হ্যাংগার গেটে স্ক্যানার না থাকায় রয়েছে অরক্ষিত। যাত্রীসেবা নিশ্চিত আর চোরাচালান রোধে সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও তা যথেষ্ট নয়। কাস্টমসের জনবল ঘাটতির সঙ্গে রয়েছে সীমাবদ্ধতাও।
অরক্ষিত এসব গেটে স্ক্যানার বসানো, কারেন্সি স্টল সরিয়ে নেওয়াসহ আধুনিক যাত্রীসেবা ও রাজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিতে পাঁচ সুপারিশ করেছে ঢাকা কাস্টম হাউস। সম্প্রতি ঢাকা কাস্টম হাউস কমিশনার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে এ-সংক্রান্ত চিঠি দিয়েছে। যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ নিতে এর আগে এনবিআর কাস্টম হাউসকে নির্দেশনা দেয়। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক যাত্রীসেবা, ভৌত ও রাজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে চিঠিতে সুপারিশ করা হয়। এতে বলা হয়, এ বিমানবন্দরের মাধ্যমে বিদেশ হতে আগত ও গমনেচ্ছুদের সেবা নিশ্চিত করা এ কাস্টম হাউসের গুরুদায়িত্ব। এ হাউসের এয়ারপোর্ট ইউনিট যাত্রীসেবা নিশ্চিত ও নির্বিঘœ করতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া বিমানবন্দরকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে সংঘটিত যে কোনো চোরাচালান প্রচেষ্টাকে কঠোরভাবে দমন করতে অহর্নিশ কাজ করে যাচ্ছে। এসব কাজ করতে গিয়ে কাস্টমস প্রায়ই নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হয়। এসব সমস্যার আশু সমাধানে পাঁচটি সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে একদিকে যাত্রীসেবা ত্বরান্বিত হবে, অন্যদিকে চোরাচালান বহুলাংশেই প্রতিরোধ সম্ভব হবে।
বিমানবন্দরের ভেতরে থাকা কয়েকটি কারেন্সি এক্সচেঞ্জ স্টলকে হুমকি উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, বিমানবন্দরের ভেতরে কাস্টমস হলের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের বিভিন্ন সেবা দেওয়া হয়। কাস্টমস হল গ্রিন ও রেড চ্যানেল নামে দুটি অংশে বিভক্ত। ব্যাগেজ বিধিমালা মোতাবেক, সচরাচর এ হলের সীমানার মধ্যেই যাত্রী ও ব্যাগ তল্লাশি করা হয়। কাস্টমস হলের আগে ও ইমিগ্রেশনের ঠিক পরেই কয়েকটি কারেন্সি এক্সচেঞ্জ স্টল রয়েছে। কাস্টমস বলছে, ইমিগ্রেশন-সংক্রান্ত কার্যক্রম শেষ করার পর কোনো যাত্রীর সঙ্গে আনীত স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা প্রভৃতি চোরাচালানের মাধ্যম হিসেবে স্টলগুলোতে কর্মরত ব্যক্তিদের ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
আরও বলা হয়, এসব স্টলে কর্মরতদের পরিচয়পত্র দেয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। তাদের তল্লাশি করা সম্ভব হয় না। কাস্টমসের পক্ষে তা শোভনীয়ও নয়। কাস্টমস বলছে, কারেন্সি স্টলের মতো স্থাপনা বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশ্বের কোনো কাস্টমস এরিয়ায় কারেন্সি এক্সচেঞ্জ স্টল থাকার নজির না থাকায় এসব স্টল জরুরি ভিত্তিতে অপসারণের সুপারিশ করা হয়েছে।
অভ্যন্তরীণ যাত্রীদের তল্লাশির সুপারিশ করে চিঠিতে বলা হয়, বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল রয়েছে। আন্তর্জাতিক কয়েকটি ফ্লাইট শাহ আমানত বা ওসমানী বিমানবন্দর হয়ে শাহজালালে অবতরণ করে। চট্টগ্রাম ও সিলেট হতে আগত অভ্যন্তরীণ যাত্রীরা এসব ফ্লাইটে শাহজালালে আসেন। ফলে বিদেশ থেকে আগতরা এসব অভ্যন্তরীণ যাত্রীর কাছে স্বর্ণ, বৈদেশিক মুদ্রা বা অবৈধ পণ্য হস্তান্তরের সুযোগ রয়েছে। কারণ, আন্তর্জাতিক যাত্রীর ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস তল্লাশির বাধ্যবাধকতা থাকলেও অভ্যন্তরীণ যাত্রীর তা নেই। কাস্টমস হলে আন্তর্জাতিক যাত্রীদের সেবা ও তল্লাশি করে কাস্টমস। তবে গোপন সংবাদ ছাড়া অভ্যন্তরীণ যাত্রীদের তল্লাশি করা হয় না। ফলে কানেক্টিং ফ্লাইটে চোরাচালান করা হয়। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কারণ, কাস্টমস এরই মধ্যে এ ধরনের ফ্লাইট থেকে স্বর্ণ, মুদ্রা ও আমদানিনিষিদ্ধ পণ্য আটক করেছে। চোরাচালান রোধে কানেক্টিং ফ্লাইটের আন্তর্জাতিক যাত্রীর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ যাত্রীদের কাস্টমস হলের মাধ্যমে সেবা ও তল্লাশি বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করা হয়।
আরও একটি কাস্টমস হল স্থাপনের সুপারিশ করে বলা হয়, দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মধ্যে শাহজালাল দিয়ে সর্বাধিক যাত্রী যাতায়াত করেন। শাহজালালে প্রায়ই সাত-আটটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে প্রায় ছয় হাজার যাত্রী একসঙ্গে অবতরণ করেন। দৈনিক ১০০ ফ্লাইটে প্রায় ৪০ হাজার যাত্রী অবতরণ করেন। একটি কাস্টমস হলে এসব যাত্রীকে সেবা দেওয়া ও ব্যাগ তল্লাশি করা প্রায় অসম্ভব। যাত্রীজট কমাতে অনেক সময় তল্লাশি করা হয় না। এরই মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ও সন্দেহজনক কতিপয় ফ্লাইটের যাত্রীদের তল্লাশি করতে গিয়ে যাত্রীজট তৈরি হওয়ায় বিভিন্ন দপ্তর থেকে হয়রানির অভিযোগ করা হয়েছে। যাত্রীদের দ্রুত সেবা নিশ্চিত ও চোরাচালান রোধে আরও একটি কাস্টমস হল স্থাপনের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়।
স্টাফ গেটে স্ক্যানার স্থাপনের সুপারিশ করে বলা হয়, বিমানবন্দরের দ্বিতীয় তলায় একটি স্টাফ গেট রয়েছে। এ গেট মূলত বিমানের ক্রু, শ্রমিক, বিভিন্ন ডিউটি ফ্রি শপের কর্মীসহ অন্যান্য কর্মী ব্যবহার করেন। এ গেটে কোনো স্ক্যানার না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে তা চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহƒত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কাস্টমস এরই মধ্যে অভিযোগের ভিত্তিতে এ গেটে বিভিন্ন কর্মীর কাছ থেকে স্বর্ণ ও অবৈধ পণ্য জব্দ করেছে। বিমানবন্দরের মতো সংবেদনশীল স্থানে গেটটি অনেকটাই অরক্ষিত। চোরাচালান রোধে এ গেটে একটি স্ক্যানার বসাতে সিভিল এভিয়েশনকে অনুরোধ করার সুপারিশ করা হয়। তারা অপারগতা প্রকাশ করলে কাস্টম হাউসকে স্ক্যানার স্থাপনের অনুমতি দিতে এনবিআরকে সুপারিশ করা হয়।
হ্যাংগার গেটে স্ক্যানার স্থাপনের সুপারিশ করে চিঠিতে বলা হয়, এ গেট বিমানবন্দরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ গেট ব্যবহার করে যানবাহন ও পণ্যদ্রব্য বিমানবন্দরের রানওয়েতে আনা-নেওয়া করা হয়। এ গেটে পুরাতন ও প্রায় বিকল একটি ব্যাগেজ স্ক্যানার রয়েছে। বিমানবন্দর থেকে এ গেট দিয়ে ব্যক্তি ও যানবাহন তল্লাশি না করায় প্রায়ই গেটটি অরক্ষিত থাকে। এ গেট দিয়ে চোরাচালান রোধে একটি ভেহিক্যাল, একটি ব্যাগেজ, একটি হিউম্যান স্ক্যানার ও একটি আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর বসাতে সিভিল এভিয়েশনকে অনুরোধ জানাতে সুপারিশ করা হয়। না হয় অর্থ বরাদ্দ দিলে কাস্টম হাউস তা স্থাপনের উদ্যোগ নেবে।