নিরাপদ সড়ক নয়, চাই নিরাপদ যাতায়াত

আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: বাংলাদেশে সড়ক হলো নাগরিক নিপীড়নের কারখানা। এটা সময় খেয়ে নেয়, স্বাস্থ্য খেয়ে নেয়, উপার্জন খেয়ে নেয়, এমনকি জীবনও খেয়ে নেয়। এর ফলে সড়ক হয়ে উঠছে মাইনফিল্ড। সড়কে কাঠামোগত নৈরাজ্যের ফলে মানুষ মরলে এই অপমৃত্যুর ঘটনাকে ঢেকে ফেলা হয় ‘দুর্ঘটনা’ শব্দ দিয়ে। সড়কে যাতায়াত খাতে ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলার বিষয়টি খুবই হতাশাজনক। তাই আমাদের দাবি হওয়ার কথা ছিল নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করার জন্য আইন। যা বোঝাতে চাচ্ছি তা বলছি না, আবার যা বলছি তা বোঝাতে পারছি না। বোঝাতে চাওয়া এবং বলার মধ্যেই যোজন যোজন তফাত রয়েছে, তাই অধিকার নিশ্চিত হবে কীভাবে? আমরা অনেকেই বলছি কী, আর আমরা চাই কীÑদুটি বিষয়ের মধ্যে অনেক তফাত ও ফাঁক রয়েছে। সুতরাং যা বোঝাতে চাচ্ছি, তা-ই বলতে হবে। 

সঠিকভাবে দাবি না করা এবং বোঝাতে না পারার ফলে ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ পাস করেছে সরকার। ওই আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছিল, কিন্তু কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করা যাবে, তা উপেক্ষিত হয়েছে। এর ফলে ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ প্রণয়নের তিন বছর পার হলেও সেটি তেমন কার্যকর নয় এবং এই সময়ের মধ্যে দেশে দুর্ঘটনা ও নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ২০২১ সালের নভেম্বর মাসেই সড়কে অপমৃত্যুতে (দুর্ঘটনায়) ৫৪ শিক্ষার্থীর প্রাণ ঝরেছে। এ বছরের জানুয়ারি মাসেই মারা গেছেন ৭৯ শিক্ষার্থী। গত ১১ মাসে সড়কে পিষ্ট হয়ে মারা গেছেন পাঁচ হাজার ১৪৪ জন। তাদের মধ্যে শিক্ষার্থী ছিলেন ৭৩৭ জন।

তাই আমাদের চিন্তা-ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, নিরাপদ সড়ক চাই, নাকি নিরাপদ যাতায়াত চাই? সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের অকালে মৃত্যু বা অপমৃত্যু ঠেকাতে দরকার নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কিন্তু আমরা অনেকেই চাচ্ছি নিরাপদ সড়ক। যাতায়াতের মাধ্যম হচ্ছেÑপায়ে হেঁটে ও বাইসাইকেলে যাতায়াত; ভ্যানগাড়ি, ঠেলাগাড়ি ও রিকশায় যাতায়াত এবং যান্ত্রিক বাহনে নদীপথে ও আকাশপথে যাতায়াত।

আমরা যখন সড়কপথে যাতায়াত করি, তখন কোনো চোর, ডাকাত বা দস্যু দ্বারা আক্রমণ বা বাধাপ্রাপ্ত হলে দরকার বা প্রয়োজন সড়ক নিরাপদ করার। নিরাপদ সড়কের প্রয়োজন অবশ্যই আছে, কিন্তু তার থেকে কোটি গুণ বেশি প্রয়োজন নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করা। বিগত কয়েক দশকে কতগুলো মানুষ সড়কে চোর, ডাকাত বা দস্যু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। আর কত হাজার নিরপরাধ মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করছে এবং পঙ্গু হয়েছে নিরাপদে যাতায়াত করতে না পারার কারণে, তা ভালো করে ভেবে দেখা দরকার। নিরাপদ সড়ক দিয়ে নিরাপদে যাতায়াত নিশ্চিত করা যাবে কিÑএটাই বড় প্রশ্ন।

সড়ক যখন কেউ কেটে ফেলে বা গর্ত খুঁড়ে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত করে বা করতে উদ্যত হয়, তখন দরকার হবে নিরাপদ সড়কের। এছাড়া নিরাপদ সড়কের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হচ্ছে ডাকাতি ও দস্যুতা থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, যা সরাসরি নিরাপদ যাতায়াতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। রাষ্ট্র বিগত তিন দশকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে অনেকাংশে সক্ষম হলেও নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে এখন পর্যন্ত সার্বিকভাবে সফল হয়েছে বলে মনে হয় না।

নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে হলে গাড়িচালককে যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান, গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা, সড়ক পারাপারের জন্য সাউন্ড সিস্টেম, বেল বাটন-সহ জেব্রা ক্রসিং নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া মানুষ যখন সড়কপথে যাতায়াত করবেন, তখন পদচারী সেতুর নিচে চাপা পড়ার আশঙ্কা থাকবে না। অথবা কোনো যান্ত্রিক বা অযান্ত্রিক যানবাহন বা বিলবোর্ডের চাপায় পড়ে আহত বা নিহত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। এজন্যই দরকার নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যানের তথ্যমতে, গত ছয় বছরে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ হাজার ৮৫৬ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ৮৯ হাজার ৮৬ জন। সড়ক উন্নয়নে গত এক যুগে জাতীয় বাজেটে ধারাবাহিকভাবে বরাদ্দ বেড়েছে। এই সময়ে নতুন সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি পুরোনো সড়কও চওড়া হয়েছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ পাস করেছে সরকার। কিন্তু প্রয়োজন ছিল নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করার জন্য দাবি উত্থাপন ও আইন করা, যেহেতু মানুষের যাতায়াত নিরাপদে হচ্ছে না। তাই বাস্তবতা হচ্ছে, সড়কে অপমৃত্যু না কমে আরও বেড়েছে। করোনা মহামারির মধ্যেও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ২০২১ সালে কয়েক ধাপে বাংলাদেশে মোট ৮৫ দিন গণপরিবহন চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ ছিল। এরপরও গত এক বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় অপমৃত্যু বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এর আগে ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই বাসচাপায় শহীদ রমিজউদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হন। আহত হন আরও ১৫ জন। প্রতিবাদে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। এই নৈরাজ্যকর লাগাম টেনে ধরার কেউ নেই, কল্যাণ রাষ্ট্র নিরপরাধ মানুষের অস্তিত্ব বিনাশ করতে এ রকম আচরণ করতে পারে কি?

প্রতি বছর বাংলাদেশের হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষের অকাল মৃত্যুর দায়-দায়িত্ব কেউ নিতে চান না। কিন্তু প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনার নামে চলছে নিরপরাধ মানুষের অকাল মৃত্যু, যাকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। কোনো কর্তৃপক্ষই এর দায় নিতে চায় না, বরং দায় এড়াতে বদ্ধপরিকর। যদিও সড়কে নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের অনেক দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তার পরও নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের আন্তরিকতার ঘাটতি অনেকাংশে দেখা যাচ্ছে। বিগত দিনের অভিজ্ঞতার বলে সড়কগুলো নিরাপদ থাকার পরও সড়কপথে মানুষের যাতায়াত নিরাপদ ছিল না।

জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো ২০২০ সালের মধ্যে তাদের নিজ নিজ দেশে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও প্রাণহানি অর্ধেকে নামিয়ে আনবে বলে সম্মত হয়েছে। সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশেরও দায়বদ্ধতা রয়েছে। যাতায়াত ব্যবস্থায় এ মুহূর্তে সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করে প্রাণহানি কমানো। সড়ক, যানবাহন ও দক্ষ চালক যাতায়াত ও পরিবহন খাতে শৃঙ্খলার তিন মূল নিয়ামক। কিন্তু দেশের এর কোনোটিই ত্রুটিমুক্ত নয়। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসছে না। আবার আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে এ খাতকে সুশৃঙ্খল রাখার ব্যবস্থাও কার্যকর নয়। তাই প্রয়োজন নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিতের দাবি করা। সেখানে বড় বাধা রাজনৈতিক প্রভাব। ফলে বিশৃঙ্খলার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে যাতায়াত ব্যবস্থা। বাংলাদেশে সড়ক নিরাপদ হলেও কখনোই যাতায়াত নিরাপদ ছিল না। এই সমস্যাটা গভীর ও বহুমুখী, তাই এর সমাধানের ক্ষেত্রেও বহুমুখীভাবে সমন্বিত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কাজ করতে হবে। যাতায়াত নিরাপদ করতে জনপ্রত্যাশা মেনে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে প্রাণহানি কমানো ছাড়া সরকারের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। তাই নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার।

আইনজীবী

masumbillahlaw06@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০