Print Date & Time : 25 June 2025 Wednesday 12:20 pm

নির্বাচনে মনোনয়ন দানে সততাকে গুরুত্ব দিন

একাদশ জাতীয় সংসদে ৬১ শতাংশ সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী। রাজনীতিবিদ ছিলেন ৫ শতাংশ। বাকি ৩৪ শতাংশের মধ্যে আইনজীবী ১৩ ও অন্যান্য পেশার রয়েছেন ২১ শতাংশ। এটি টিআইবি প্রণীত ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ শীর্ষক গবেষণা  প্রতিবেদনের তথ্য। টিআইবি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, প্রথম সংসদে মাত্র ১৮ শতাংশ সদস্যের পেশা ছিল ব্যবসা। ক্রমান্বয়ে এ হার বৃদ্ধি পেয়ে ৬১ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকার নির্বাচনে ডেমোক্রেসি যেমন ডলারোক্রেসি, বাংলাদেশের ইলেকশনগুলোও তেমন ইনকাম জোন।

ইউপি নির্বাচনে একজন সদস্যর লাখ লাখ টাকা খরচ করে নির্বাচন করে। চেয়ারম্যানের খরচের হিসাব নাকি কোটির ঘরে। তাদের এ টাকার উৎস কোথায়? যত দূর জানি,  প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয়ে রাষ্ট্র কোনো সহায়তা দেয় না। অথবা নির্বাচন করার জন্য দলীয়ভাবে কোনো আর্থিক সহায়তাও প্রদান করা হয় না। একজন প্রার্থী কোনো জায়গা থেকে আর্থিক সহায়তা পাওয়া তো দূরের কথা, তারা মনোনয়ন বাণিজ্যে তাদের মোটা অঙ্কের টাকা খুইয়ে আসে।

একটা নোংরা প্রবণতা চালু হয়ে গেছে সমাজে। প্রার্থীরা এখন টাকা দিয়ে ভোট কেনে। ভোটাররাও সামান্য কয়টি টাকার জন্য ভোট বিক্রি করে। এখন প্রার্থীর সততা, দক্ষতা এবং যোগ্যতা সব টাকার ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ যে প্রার্থীর টাকা আছে মোটামুটি তাকেই নির্বাচনের আগে জনপ্রতিনিধি হতে যাচ্ছে বলে ধরে নেয়া হয়। নির্বাচনের উৎসবমুখর সেই পরিবেশ আর নেই।

আর যেই পরিমাণ টাকা খরচ করে চেয়ারম্যান-মেম্বার হয়, ভোটে জেতার পর তারা সেই পরিমাণ টাকা উসুল করতেই ব্যস্ত থাকে।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনের চাইতে জাতীয় নির্বাচনের অবস্থা আরও করুণ। সেখানে মনোনয়ন বাণিজ্য থেকে শুরু করে নির্বাচনী প্রচারণাসহ একেবারে ভোটের ফলাফল প্রকাশের আগ পর্যন্ত টাকার ছড়াছড়ি। অঘোষিতভাবেই নির্বাচন আর টাকা সমর্থক শব্দে পরিণত হয়েছে।

জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বাড়ার বড় একটা কারণ হলোÑনমিনেশন নিতে যে পরিমাণে টাকার প্রয়োজন হয় সাধারণ কোনো নাগরিকের পক্ষে নমিনেশন ক্রয় করা সম্ভব নয়। ব্যবসায়ীরা মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে নমিনেশন ক্রয় করেই ক্ষান্ত থাকে না। তারা তাদের অর্থ-সম্পদের বদৌলতে নির্বাচনী প্রচারণায় মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে। এমনকি অনেক সাধারণ স্বতন্ত্র প্রার্থীকে টাকা দিয়ে নির্বাচন থেকে মাইনাস করে। ফলাফল প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত জনগণের সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেন রাখে। ফলাফল হয়ে গেলে বা পার্লামেন্ট মেম্বার হওয়ার পরে সাধারণ জনগণের সঙ্গে আর তাদের কোনো সম্পর্ক থাকে না।

এসব ব্যবসায়ী সংসদ সদস্য হন ব্যক্তিগত স্বার্থে। তাদের ব্যবসায়ীক কর্মকাণ্ডকে আরও বৃহৎ পরিসরে বৃদ্ধি করতে কোনো প্রকার রাজনৈতিক বা সরকারি বাধার সম্মুখীন যাতে না হতে হয় এটাই তাদের অন্যতম লক্ষ্য। এছাড়া বিদেশে ব্যবসায়ীক স্বার্থে যাওয়া-আসা এবং বিদেশি সংস্থার সঙ্গে সহজেই যাতে ব্যবসায়িক কাজ করতে পারে এটাও একটা কারণ।

এজন্য এসব ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদরা জনগণের সংস্পর্শে থাকে না। জনগণও নির্বাচনী প্রচারণা বাদে এদের চেহারা দেখে না। কথা হচ্ছে সাংবিধানিকভাবে দেশের সবারই রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অধিকার আছে। সাংসদ হওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু এরা সাংসদ হচ্ছে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে। জনসেবা এদের মূল লক্ষ্য নয়।

এই ব্যবসায়িক গোষ্ঠী সাংসদ হওয়ার কারণে ইচ্ছামতো বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ওঠানামার ক্ষেত্রেও তাদের হাত থাকে। তারা সাধারণ জনগণের কষ্ঠ না বুঝে শুধু ব্যবসায়িক মানসিকতার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।

শুধু তাই নয়। সংসদে অধিবেশন চলাকালেও তারা অধিকাংশ সময় উপস্থিত হয় না। একজন সাংসদ হিসেবে, আইনপ্রণেতা হিসেবে বিভিন্ন বিলের ওপর আলোচনা বা মতামত প্রদানের প্রয়োজনও মনে করে না। যে আসন থেকে তারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয় সে আসনের সাধারণ জনগণের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে সংসদে কখনও আলোচনা করে না। শুধু বায়ু পরিবর্তন করতে মন চাইলে কালেভদ্রে কিছু সংসদ সদস্য তাদের আসনে বেড়াতে যায়।

ব্যবসায়ীরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর মনোনয়ন ক্র?য় করতে যত টাকা খরচ হইছে সেটা উসুল করতে ব্যস্ত হয়ে পরে। এমনকি নির্বাচনী প্রচারণায় তারা যে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে সেটার কয়েকগুণ তুলতে মরিয়া হয়। সঙ্গত কারণেই ওইসব ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদরা কখনও জনকল্যাণে মনোযোগী হতে পারে না। তবে সবাই যে একরকম হয় এমনটিও নয়। অনেকেই ব্যবসাও করেন একই সঙ্গে ত্যাগী রাজনীতিবিদ। ব্যবসা সামলিয়ে জনগণের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের দুঃখ-দুর্দশা শুনে সেটা লাঘব করার চেষ্টা করেন এমন ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদও আছেন। তবে এই সংখ্যাটা খুবই কম।

আশা করি আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল একেবারে ত্যাগী এবং পরিক্ষিত রাজনীতিবিদকে মনোনয়ন দেবে। কোনো রাজনৈতিক দল মনোনয়নকে বাণিজ্য হিসেবে পরিচিত না করিয়ে জনগণের সেবা যারা নিশ্চিত করবে তাদেরই মনোনয়ন দেবে। রাজনীতিতে সবার আসার অধিকার থাকলেও অতীতের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে যারা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে সংসদ নির্বাচন করে সাংসদ হওয়ার পর জনগণকে ভুলে যায়, তাদের মনোনয়ন যাতে না দেয়া হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সে বিষয়ে সম্পূর্ণ সজাগ থাকবে এটাই কামনা করি।

শফিকুল ইসলাম নিয়ামত

শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়