আজহার মাহমুদ: ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা। অনেক ওজনদার একটি নাম। না, এটা শুধু আমার কথা নয়, এটা পুরো বাংলাদেশের কথা। সবসময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অন্যতম ইস্যু হয়ে থাকেন এই মানুষটি কখনও দলকে জিতিয়ে, কখনও ভালো বল করে, কখনও উইকেট নিয়ে, কখনও অবিশ্বাস্য ক্যাচ ধরে, কখনও চোখধাঁধানো ব্যাটিং কিংবা বড় বড় ছয় মেরে। ফেসবুকে ঢুকলেই চোখে পড়ে মাশরাফিকে নিয়ে হাজার হাজার লেখালিখি। লেখাগুলো বিখ্যাত লেখকরা লেখেন না, লেখেন বাংলাদেশেরই সাধারণ মানুষ। কারণ মাশরাফিকে অসাধারণ থেকে সাধারণ মানুষরাই বেশি ভালোবাসেন। এককথায় বলা যায় সবাই ভালোবাসেন। এ নিয়ে আমার কোনো দ্বিমত নেই। মাশরাফি সম্পর্কে আমার তেমন বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন আছে বলেও মনে হয় না। কারণ মাশরাফি কী, কেমন, সেটা সবাই জানেন বলেই তার প্রতি মানুষের ভালোবাসার পাল্লা ভারী। তবে তার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের মাধ্যমে বাংলাদেশে সৃষ্টি হলো এক নতুন ইস্যু।
নড়াইল-২ আসন থেকে প্রার্থী হতে আওয়ামী লীগের ফরম নিয়েছেন নড়াইল এক্সপ্রেস-খ্যাত মাশরাফি। এই আসনটিতে মহাজোট সরকারের গত নির্বাচনে সংসদ সদস্য ছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির শেখ হাফিজুর রহমান। যাইহোক মূল কথায় ফিরে আসি। মনোনয়ন নেওয়ার আগ পর্যন্ত যে মাশরাফিকে মানুষের কাছে দেখেছিলাম, মনোনয়ন নেওয়ার পর সেই মানুষটিকে যেন সেভাবে আর দেখা যাচ্ছে না। আমি আমার জীবনে যা কখনও আশা করিনি ঠিক সেরকমই কিছু দেখেছি। যে মাশরাফিকে নিয়ে হরহামেশা মানুষ আবেগি আর ভালোবাসায় মোড়ানো স্ট্যাটাস দিতেন, তারাই আজ সেই মানুষটিকে নিয়ে বাজে বাজে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। যে মানুষটিকে নিয়ে ফেসবুকে লম্বা লম্বা গল্প বানিয়ে পোস্ট করে যারা সাধারণ মানুষের ভেতর ভালোবাসা বাড়িয়ে দিতেন, তারাই আজ মাশরাফিকে ইঙ্গিত করে অপরাধী বলছেন। না, এটা কোনো গল্প কিংবা সিনেমার কাহিনি নয়, এটাই এখন বাস্তব। আর এখন এটাই হচ্ছে। কিন্তু কেন? রাজনীতি করা তো কোনো অপরাধ নয়। একটা দেশ পরিচালনা করেন রাজনীতিবিদরা। অনেকেই বলেন বাংলাদেশের এই পচা রাজনীতিতে মাশরাফি কেন যোগ দিয়েছেন? তার মানে তাদের কথা পচা রাজনীতি আরও পচে যাক, তবুও রাজনীতিতে ভালো মানুষ না আসুক। রাজনীতি প্রতিটি ধর্মে আছে। ইসলামেও বলা আছে রাজনীতির কথা। আমি মনে করি যারা রাজনীতি করতে না করেন, তারা ধর্ম সম্পর্কেও অজ্ঞ।
আপনি বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ঐক্যফ্রন্ট, জামায়াত করেন বলে কি মাশরাফি খারাপ? এ জন্যই কি মাশরাফির প্রতি আপনার ভালোবাসা শেষ? তাহলে বলব, মাশরাফির প্রতি আপনার ভালোবাসা কখনোই ছিল না। স্বার্থের জন্য ভালোবাসতেন মাশরাফিকে। মাশরাফির জন্য মাশরাফিকে ভালোবাসেননি। যদি বাসতেন তাহলে আপনার বিপক্ষ দল হোক আর যেই দলই হোক, ব্যক্তি মাশরাফিকে আপনার ভালোবাসতেই হবে। আপনি বলতে পারেন আলাদা একটি দল নিয়ে রাজনীতিতে আসতে পারত। কিন্তু আপনার মতামতটা আপনার কাছে, আর মাশরাফিরটা মাশরাফিই ভালো বোঝেন। মাশরাফি যখন মাঠে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন তখন কি আপনি মাঠে গিয়ে মাশরাফিকে শিখিয়ে দিয়ে আসেন? নাকি আপনি মাঠে গিয়ে মাশরাফিকে বলে
দেন কখন কাকে বল দিতে হবে। কাকে কী বলতে হবে, কখন কী করতে হবে, সেটা মাশরাফি জানেন এবং বোঝেন বলেই মাশরাফির প্রতি মানুষের ভালোবাসা এত। কিন্তু আজ রাজনীতির বেলায় এসে তার সঙ্গেও অনেকে রাজনীতি করছি। যাইহোক, রাজনীতি করা যেতে পারে, তবে মাশরাফিকে কষ্ট দেওয়া যেতে পারে না। যে মানুষটা অনেকবার পায়ের অপারেশন করেও সেই পা নিয়ে আমাদের জন্য ২২ গজে ফিরে এসেছেন, সেই মানুষটাকে কীভাবে এত সহজে অবিশ্বাস করতে পারি আমরা? আমাদের বুঝতে হবে এবারও তিনি কোনো ভালো কাজের উদ্দেশ্যে রাজনীতিতে এসেছেন এবং আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। আমি বলছি না এই কারণে আওয়ামী লীগকে ভালোবাসতে হবে, কিন্তু মাশরাফিকে এবং তার কাজকে ভালোবাসতে তো ক্ষতি নেই। এই মানুষটার পাশে ছিলাম বলেই তো ক্রিকেটে আমরা অনেক জয় পেয়েছি। এখনও তাকে উৎসাহ দিয়ে দেশের উন্নয়নে পাশে থাকুন। এটাই যথেষ্ট। আর নেহায়েত তাকে ভালোবাসতে না পারেন, কিন্তু কুমন্তব্য করবেন না।
অনেকে বলেন খেলার মাঠে মাশরাফি দেশের জার্সি পরে নামবেন, তিনি এই মুহূর্তে রাজনীতিতে কেন এলেন? কিন্তু আমরা জানি না যে এই মানুষটি ক্যারিয়ারের শেষাংশে চলে এসেছেন। এরই মধ্যে টেস্ট ক্রিকেট ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে অবসরে গেছেন। বাকি ওয়ানডে এবং আগামী জুনে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপের মাধ্যমেই তিনি তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ করবেন। এরপর তিনি কী করবেন, তখন কি তার জন্য আরেকবার সংসদ নির্বাচন করতে পারবেন কেউ? উত্তরে ‘না’ ছাড়া আর কিছুই আসবে না। তাই আগে চিন্তা করবেন, তারপর মন্তব্য করবেন, এটাই শ্রেয়। আর মাশরাফি ক্রিকেট খেলা অবস্থায় রাজনীতিতে আসছেন, নির্বাচন করছেন। এটা নজিরবিহীন এমনও নয়, এমন নজির আগেই স্থাপন করেছেন শ্রীলঙ্কার সনাথ জয়াসুরিয়া। সনাথ জয়াসুরিয়া ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাহেন্দ্র রাজাপাকসের ইউনাইটেড পিপল ফ্রিডম অ্যালায়েন্সে যোগ দেন এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এমপি হয়ে যাওয়ার পরও খেলা চালিয়ে যান জয়াসুরিয়া। ২৮ জুন ২০১১ সালে দেশের হয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন তিনি এবং এরও এক বছর পর শ্রীলঙ্কার ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। ২০১২ সালে জয়াসুরিয়া খুলনা রয়েল বেঙ্গলসের (কেআরবি) হয়ে বিপিএলও খেলে যান। জয়াসুরিয়া যেমন ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শেষের দিকে রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছিলেন, মাশরাফিও সেই একই পথে। এখানে জয়াসুরিয়ার সঙ্গে মাশরাফির একটা বড় মিল। কিন্তু দেশের মানুষের মন্তব্যটা শুধু ভিন্ন।
আর ক্রিকেটারদের রাজনীতি? সেটাও এই উপমহাদেশের নতুন কিছু নয়। ভারতের সেই মনসুর আলী খান পাতৌদি, নবজ্যোত সিং সিধু, বিনোদ কাম্বলি, মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, অর্জুনা রানাতুঙ্গা, বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয়, শ্রীলঙ্কার সনাথ জয়াসুরিয়াসহ অনেকেই এসেছেন রাজনীতিতে। কেউ কেউ সফল হয়েছেন, আবার কেউবা ব্যর্থ হয়েছেন। তবে ক্রিকেটার রাজনীতিবিদ হিসেবে সবচেয়ে সফল হওয়া নাম পাকিস্তানের ইমরান খান।
মাশরাফি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রে ভর্তি হলেও লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি ক্রিকেটের কারণে। ১৭ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ২০০১ সালের নভেম্বরে। টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে শুরু এবং আগামী বছরের জুনের ওয়ানডে দিয়ে ক্রিকেট ক্যারিয়ার সমাপ্তির আলোচনা রয়েছে। ক্রিকেটের কারণে লেখাপড়া শেষ করতে না পারলেও তিনি সবসময় মানুষের সংস্পর্শে ছিলেন। নিজের শহর নড়াইলে গড়েছেন তিনি ‘নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশন’। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। গতবছরের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) রংপুর রাইডার্সকে শিরোপা জিতিয়ে তিনি দলের মালিকের কাছ থেকে অ্যাম্বুলেন্স চান। পেয়েছেনও বটে। আর পাবেনই বা না কেন। এটা যে মানুষের কল্যাণের জন্য। এলাকার মানুষের প্রতি তার এমন ভালোবাসা, মমতা আর অঙ্গীকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগের অন্যতম দৃষ্টান্ত। নেতৃত্বগুণ ও ব্যক্তিমানুষ হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় মাশরাফি দেশের ৩০০ আসনের মাত্র একটি আসনের একজন মনোনয়নপ্রত্যাশী হয়েও আলোচনায়। আলোচনায় থাকাটা খারাপ নয়, তবে বদ আলোচনা অবশ্যই খারাপ। কারণ মানুষটা যে মাশরাফি। এখন পর্যন্ত বলা যায় খেলোয়াড়ি জীবনে সফল এক ব্যক্তি মাশরাফি। তিনি শুধু বাংলাদেশের সফল একজন অধিনায়কই নন, বাংলাদেশের পক্ষে ওয়ানডে ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। এমন এক অধিনায়ক ও ব্যক্তিত্ব অবসরের দুয়ারে এক পা দিয়ে যখন গণমানুষের সেবার নিমিত্তে রাজনীতিতে নাম লেখান, তখন স্বাগত না জানানোর যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছি না। তবে একদিন এই ভুল সবাই বুঝতে পারবেন, আর তখন বলবেন: ‘ভুল করে তোমায় করেছি অসম্মান/ আর নিজেকে করেছি পাপিষ্ঠ/ ক্ষমা চাওয়ার ভাষা নেই আজ/ অনুশোচনার নেই অবশিষ্ট।’
শিক্ষার্থী
ওমরগনী এমইএস কলেজ, চট্টগ্রাম
azharmahmud705@gmail.com