শেয়ার বিজ ডেস্ক: প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন দেশের ভবিষ্যৎ গভীর অন্ধকারের দিকে নিয়ে যেতে পারে জানিয়ে আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।
সংগঠনটি বলছে, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে ৭ জানুয়ারি আমরা ২০১৪ এবং ২০১৮-এর মতো অগ্রহণযোগ্য আরেকটি নির্বাচন দেখতে চলেছি। নির্বাচনের ফলাফল কী হতে যাচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়। অর্থনীতির অবস্থা ও ভূরাজনীতিক বিন্যাসে বাংলাদেশের অবস্থান বিবেচনায় এরকম প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন দেশের ভবিষ্যতকে গভীর অন্ধকারের দিকে নিয়ে যেতে পারে। আমরা এ নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করি। আমরা মনে করি, উদ্ভূত সংকটের সমাধান গণতান্ত্রিক উপায়ে সরকারকেই করতে হবে।
শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) দেশবাসীর উদ্দেশে লেখা খোলা চিঠিতে এসব কথা উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠনটি নির্বাচন প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন এ খোলা চিঠি গণমাধ্যমে পাঠিয়েছেন।
খোলা চিঠিতে বলা হয়, আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের সব নাগরিকের মতো আমরাও গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং শঙ্কিত। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি অপরিহার্য উপাদান হলো অবাধ, অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। জনগ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন যেকোনো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বৈধতার প্রধানতম উৎস। এ কারণে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় সার্বিক শাসন ব্যবস্থা একটা বৈধতার সংকটে পড়েছে। আর বৈধতার এ সংকট কাটাতে ক্ষমতায় থাকার জন্য পশ্চিমা পরাশক্তি এবং আঞ্চলিক শক্তির কাছ থেকে সম্মতি নেওয়াটাই গত এক দশকে ক্ষমতাসীনদের মূল কাজে পরিণত হয়েছে।
এতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, আমাদের দেশের নির্বাচনকে ঘিরে একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব, অন্যদিকে রাশিয়া, চীন ও ভারত তাদের নিজ নিজ স্বার্থ বিবেচনায় বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে। কখনো কখনো মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও লিপ্ত হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য স্বস্তি ও শান্তির কিছু নির্দেশ করে না। শুধু আইনি বা সাংবিধানিক নিয়ম রক্ষার যুক্তি দিয়ে যেনতেন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান শেষ কথা নয়। গ্রহণযোগ্য ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের সঙ্গে শাসনব্যবস্থার বৈধতা, গণতন্ত্র, শাসকদের জবাবদিহি ও রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এ সবকিছুই জড়িত।
‘বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের বিবেচনায় এটা বলাই যেতে পারে যে, সারাদেশ আজ এক প্রকট রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছে, যা প্রকারান্তরে একটি সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র হিসেবে বাংলাদেশের সামগ্রিক অস্তিত্বের প্রশ্নটিকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে যারাই ক্ষমতায় যাক না কেন, জনগণের কাছে তাদের কোনো জবাবদিহি থাকে না, দায়বদ্ধতা থাকে না । এরকম শাসনব্যবস্থায় দ্রব্যমূল্যের অযৌক্তিক এবং আকস্মিক বৃদ্ধিতেও সরকার তো তার দায় স্বীকার করেই না উল্টো জনমানুষের দুর্ভোগ নিয়ে নিয়মিত মিথ্যাচার অথবা উপহাস করতেও পিছপা হয় না।
‘এতে দুর্নীতিগ্রস্ত আর অসৎ মানুষদের আইনের আওতায় আনা যায় না। এরাই সাধারণত সরকারি দলের ছায়াতলে থেকে শত অপরাধ করেও আরামে-আয়েশে নির্বিঘ্নে জীবনযাপন করে। আবার এদের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে বেশি প্রভাবশালী অংশ দেশের ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়ে অর্থ শোধ করে না। দেশের মানুষের অর্থ বাধাহীনভাবে বিদেশে পাচার করতে থাকে। ফলে সৎ ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষের প্রতিদিনের স্বাভাবিক জীবনযাপন হয়ে উঠছে দুরূহ ও দুঃসহ। সার্বিকভাবে সাধারণ জনগণের ন্যায্য অধিকার ও নিরাপত্তা খর্ব হতেই থাকে। সর্বজনের উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষা সরকারি নীতিতে প্রতিফলিত হতে পারে না।
খোলা চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘গত ১০ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে যে, প্রশ্নবিদ্ধ আগের দুই নির্বাচন এ দেশে বস্তুত একটা একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা কায়েমের পথ সুগম করেছে। এ সময়কালে দেশের মানুষের সাংবিধানিক অধিকারসমূহ বিশেষ করে মতপ্রকাশ ও সমাবেশের স্বাধীনতা এবং মৌলিক মানবাধিকার নির্মমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের গুম, খুন, গুপ্ত হত্যা করার মতো গুরুতর অপরাধকেও স্বাভাবিক করে ফেলা হয়েছে। এতে আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। একই সঙ্গে সম্পদের অসম বণ্টন, পক্ষপাতিত্বমূলক বিচারপ্রক্রিয়া ও সরকারি দল ও প্রশাসনের দমনপীড়ন দেশকে এক আতঙ্কের জনপদে পরিণত করেছে।’
‘আমরা আশা করেছিলাম, এসব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সর্বজনের সমঝোতার ভিত্তিতে একটি অবাধ, প্রতিযোগিতাময় ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের প্রচেষ্টা সবার মধ্যেই থাকবে। কিন্তু আমাদের হতাশ হতে হয়েছে। আগামী ৭ জানুয়ারি যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তা বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার নবায়ন ছাড়া আর কিছুই জনগণকে দিতে পারবে না। একটি শক্তিশালী বিরোধীদলের উপস্থিতি সংসদীয় শাসন পদ্ধতির অন্যতম পূর্বশর্ত হওয়া সত্ত্বেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আগের মতো একটা পুতুল বিরোধী দলও গড়ে তোলা মুশকিল হয়ে যাবে।
কারণ অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ অনুপস্থিত বলে বিএনপিসহ ৬৩টি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন বর্জন করেছে। সরকারি দলের সঙ্গে বা সরকারি দলের সমর্থন নিয়ে যে দলগুলো দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, সেগুলো নামেমাত্র ভুঁইফোড় রাজনৈতিক সংগঠন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে এসব সংগঠনকে পরিকল্পিতভাবেই নিবন্ধন দিয়েছে।’
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলো সাক্ষী আসনগুলো নির্বাচনের আগেই ভাগাভাগি হয়ে গেছে। জাতীয় পার্টি ভাগ পেয়েছিল ২৬টি আসন। আর সংসদে বিরোধী দল হওয়ার আশ্বাস। কিন্তু ইতোমধ্যে তাদের ২৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন দমনপীড়নের অভিযোগ তুলে। বাদ বাকি যে প্রার্থীরা নির্বাচনে আছেন, তারা প্রায় সবাই সরকারি দলের। সরকারি দল একটা প্যানেল দিয়েছে, আবার বিস্ময়করভাবে নিজের দলেরই সদস্যদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়ানোর অনুমোদন দিয়েছে।
বিরোধীদের নির্বাচন বয়কটের চাপ সামলাতে এবং এ নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দেখাতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশক্রমে নিজের দলেরই সদস্যদের ডামি প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এ ঘটনা নজিরবিহীন। ফলে বলা যায়, এ নির্বাচন এমন এক কৌশলে হতে চলেছে, যে বা যারাই নির্বাচনে জিতুক না কেন—তাদের সবাই হবে ক্ষমতাসীন দলের লোক!
‘তবে সাধারণ জনগণের জন্য এ ছলচাতুরী বুঝতে পারাটা খুব কঠিন কিছু নয়। একতরফা নির্বাচন নিয়ে তাদের ভেতরে আর কোনো উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না। ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে সর্বপ্রকারে জোর-জবরদস্তি করে ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার আয়োজন চলছে’ বলেও খোলা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।