পৃথিবীর মতো এমন অন্য একটি বসবাসযোগ্য বায়ুমণ্ডলসম্পন্ন গ্রহ পাওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু তাও আমরা আমাদের সাময়িক বিলাসিতা ও সীমাহীন মুনাফা অর্জনের জন্য প্রতিনিয়তই এই বায়ুমণ্ডলকে দূষিত করছি। সারা বিশ্বে নির্মল বায়ু নিশ্চিতের লক্ষ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০১৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বরকে নীল আকাশের জন্য আন্তর্জাতিক নির্মল বায়ু দিবস হিসাবে মনোনীত করে। পরে ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছরই এই দিনটি সমগ্র বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে। এই দিনটিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বায়ুদূষণের ঝুঁকি সম্পর্কে বিশ্ব সম্প্রদায়ের ক্রমবর্ধমান সচেতনতাকে প্রতিফলিত করে এবং মানব ও পরিবেশগত স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য বায়ুর গুণমান উন্নত করার জন্য জোর দিয়ে থাকে। এ বছর এই দিনটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছেÑ‘নির্মল বায়ুর জন্য বিনিয়োগ করুন এখনই।’
আন্তর্জাতিক জার্নাল কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বায়ুদূষণকে ‘মহামারি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ‘ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি রিপোর্ট, ২০২৩’ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বায়ুদূষণে ২০২৩ সালে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ আর নগর হিসেবে বিশ্বে বায়ুদূষণে দ্বিতীয় স্থানে ছিল ঢাকা। আবার যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত বায়ুদূষণ-বিষয়ক এক বৈশ্বিক প্রতিবেদন ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স, ২০২৩ (একিউএলআই, ২০২৩)’-এ বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, দেশের মধ্যেও বিভিন্ন জেলার বায়ুর মানের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর হচ্ছে গাজীপুর। গাজীপুর জেলার বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা, যার ব্যাস সাধারণত ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটার বা এর চেয়ে ছোট (পিএম ২ দশমিক ৫), এর পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ৮৯ দশমিক ৮ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া যায়।
এই মান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানমাত্রার (অর্থাৎ পাঁচ মাইক্রোগ্রাম) চেয়ে ১৮ গুণ বেশি এবং নির্ধারিত (বার্ষিক) মানমাত্রার চেয়ে ছয়গুণ বেশি। ২০২২ সাল পর্যন্ত অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ২ দশমিক ৫-এর জন্য নির্ধারিত (বার্ষিক) প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম। এক্ষেত্রে সবচেয়ে কম দূষিত জেলা হিসেবে পাওয়া গেছে সিলেট শহর, যার প্রতি ঘনমিটারে ৪৮ দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রাম এবং এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে ৯ দশমিক সাতগুণ বেশি এবং বাংলাদেশের নির্ধারিত জাতীয় আদর্শ (বার্ষিক) মানমাত্রার চেয়ে ৩ দশমিক ২৩ গুণ বেশি।
বায়ুদূষণের কারণগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক ও আবহাওয়াজনিত কারণ, নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি, আইনের দুর্বলতা, আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা, ভৌগোলিক কারণ এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব অন্যতম। ক্যাপসের গবেষণা থেকে পাওয়া যায়, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজ থেকে ৩০ শতাংশ, ইটভাটা ও শিল্পকারখানা থেকে ২৯ শতাংশ, যানবাহন থেকে ১৫ শতাংশ আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণ থেকে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ, গৃহস্থালি ও বা রান্নার চুলার কাজের থেকে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং বর্জ্য পোড়ানো থেকে আট শতাংশ বায়ুদূষণ ঘটে।
‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স, ২০২৩’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বের সব মানুষের গড় আয়ু দুই বছর চার মাস কমছে। অপরপক্ষে বাংলাদেশের একজন নাগরিকের গড় আয়ু কমছে ছয় বছর আট মাস। এছাড়া ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজিজেস অব দ্য চেস্ট অ্যান্ড হসপিটাল ২০২১ সালে আউটডোর এবং জরুরি বিভাগ মিলিয়ে দুই লাখ ১০ হাজার রোগী চিকিৎসাধীন ছিল।
সাত বছর আগে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৮৫ হাজার। অন্যদিকে রাজধানীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের জুলাই মাসে হাসপাতালে ভর্তি, আউটডোর ও জরুরি বিভাগ মিলে রোগীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজারের কিছু বেশি। এবারের (২০২৩) জুলাইয়ে সে সংখ্যা ১৪ হাজার পার হয়েছে। আয়ুষ্কালের পরিপ্রেক্ষিতে বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ২ দশমিক ৫, যে দূষণ বাংলাদেশে মানবস্বাস্থ্যের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম হুমকি বলে জানিয়েছে কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স, ২০২৩। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, সিসাদূষণের ফলে বাংলাদেশে প্রতিবছর হƒদরোগে আক্রান্ত হয় এক লাখ ৩৮ হাজারও বেশি মানুষ এবং এ কারণে শিশুদের আইকিউ কমে যাচ্ছে এবং ফলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
বাংলাদেশে অবস্থিত আমেরিকান দূতাবাস থেকে প্রাপ্ত ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের অর্থাৎ ঢাকার গত ৯ বছরের বায়ুমান সূচক বা একিউআই’র তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাওয়া যায়, ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের বায়ুমান সূচক আগের আট বছরের আগস্ট মাসের গড় মানের তুলনায় ১ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি ছিল এবং ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালের বায়ুমান সূচক ২৪ দশমিক ৮০ শতাংশ কমে গেছে। গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার মানুষ প্রতিনিয়ত দূষিত বায়ুতে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
২০২৪ সালের আগস্ট মাসের মধ্যে ১৫ দিনের বায়ুমান ছিল ‘মধ্যম’ প্রকৃতির, ১৫ দিনের বায়ুমান ছিল ‘সতর্কতামূলক’ এবং এক দিনের বায়ুমান ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’। ক্যাপস কর্তৃক সংগৃহীত ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের অর্থাৎ ৯ বছরের আগস্ট মাসের প্রাপ্ত ২৬৫ দিনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ৯ বছরের আগস্ট মাসের মোট ২৬৫ দিনের মধ্যে ঢাকার মানুষ মাত্র ১০ দিন ভালো বা নির্মল বায়ুতে নিঃশ্বাস নিতে সক্ষম হয়েছিল। বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন একই মুদ্রার দুটি পিঠ। আবার বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে, এ ক্ষেত্রে বায়ুদূষণ জলবায়ু পরিবর্তনের ধারা ত্বরান্বিত করছে। আবার বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ধারাও বায়ুদূষণ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। প্রতিনিয়তই বায়ুমণ্ডলে জটিল মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন একে অন্যকে প্রভাবিত করছে। বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন একটি অন্যটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
জীবাশ্ম জ্বালানির দহন ও শিল্পকারখানায় নির্গত ধোঁয়া প্রচুর পরিমাণে ব্ল্যাক কার্বন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন ও ওজন নির্গত করে, যা গ্রিনহাউস গ্যাস নামেও পরিচিত। এসব দূষকের মধ্যে ব্ল্যাক কার্বন, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মিথেনকে শর্ট লাইভ ক্লাইমেট পল্যুশন বা স্বল্প আয়ুর জলবায়ু দূষক বলা হয়। এই গ্যাস ও দূষকগুলো একদিকে যেমন বায়ুদূষণের জন্য দায়ী, তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। এসব গ্যাস সূর্য থেকে আসা তাপ ধরে রাখে। আবার পৃথিবী তাপ বিকিরণ করে যে ঠাণ্ডা হবে, তাতেও বাধা দেয় এই গ্রিনহাউস গ্যাস। ফলে পৃথিবী সময়ের সঙ্গে উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে, যা বিভিন্ন জলবায়ুজনিত কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী।
বায়ুদূষণ রোধে অমাদের কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে, সবার আগে দূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত করে দূষণ কমিয়ে আনতে হবে। ঢাকার আশেপাশের ইটের ভাটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আগুনে পোড়ানো লাল ইটের বিকল্প সিমেন্ট-বালির ব্লক ইটের ব্যবহার বাড়াতে হবে। ইটের ভাটাগুলোয় উন্নত ও দূষণমুক্ত প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে। সাপ্তাহের ভিন্ন দিনে জোড়-বিজোড় পদ্ধতিতে গাড়ি চলার ব্যবস্থা করতে হবে। ফিটনেসবিহীন যানবাহন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সমন্বয়হীনভাবে রাস্তার খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করতে হবে। সেবাদানকারী সংস্থার সংস্কার কাজে সমন্বয় এনে স্বল্প সময়ে সংস্কার শেষ করতে হব। নির্মাণসামগ্রী উš§ুক্তভাবে ফেলে রাখা যাবে না। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে, যাতে করে যেখানে-সেখানে নগরবর্জ্য বা কৃষিবর্জ্য উš§ুক্তভাবে পোড়ানো না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন তৈরি, নিয়ম-নীতি প্রণয়ন, বায়ুদূষণ-সম্পর্কিত বাজেট বৃদ্ধিসহ পরিবেশ পুলিশ নিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রচলিত আইনকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় শিক্ষামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। একইসঙ্গে প্রশাসনিক ব্যবস্থার সফল প্রয়োগ একান্তভাবে প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সবার আগে সবাইকে একযোগে সমন্বিত, টেকসই, বিজ্ঞানভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে কাজ করতে হবে। সর্বোপরি জনগণকে বায়ুদূষণের সামগ্রিক বিষয়ে তথ্যপ্রদান, শিক্ষিতকরণ ও উদ্বুদ্ধকরণ অত্যন্ত জরুরি।
ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ; যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং চেয়ারম্যান, বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)