রহমত রহমান: খুলনায় নির্মিত হচ্ছে কর ভবন। দৃষ্টিনন্দন এই ভবনের নির্মাণকাজ করছে গণপূর্ত বিভাগ-২, খুলনা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন নির্মাণাধীন এই কর ভবনের নির্মাণকাজ ব্যবহƒত হচ্ছে নিন্মমানের সামগ্রী। নির্মাণকাজের গুণগতমান রক্ষায় নেয়া হয়নি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। ব্যবহƒত হচ্ছে তৃতীয় শ্রেণির ইট। মেঝেতে রাখা হয়েছে সিমেন্টের বস্তা; যাতে সিমেন্ট নষ্ট হওয়ার উপক্রম। ঢালাই কাজে কাদাযুক্ত পাথর ও চালন ছাড়াই বালি ব্যবহার করা হচ্ছে। ঢালাই কাজে স্টিলের সাটারিংয়ের পাশাপাশি ব্যবহার হচ্ছে কাঠের শাটারিং। ঢালাই কাজে ব্যবহারের আগে ইট ও পাথর পরিশোধন করা হচ্ছে না। ঢালাই কাজে সঠিকভাবে ভাইব্রেশন প্রদান করা হচ্ছে না। খুলনা কর ভবন নির্মাণ প্রকল্প পরিদর্শন করে এই ধরনের অনিয়ম পেয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে প্রকল্প পরিচালককে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রকল্পের অনুক‚লে অর্থ বরাদ্দ রয়েছে। কাজের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে বলা হয়েছে। তবে নি¤œমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের বিষয়টি অস্বীকার করেছে গণপূর্ত বিভাগ-২, খুলনা।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ১৭ সেপ্টেম্বর ‘খুলনা কর ভবন নির্মাণ’ প্রকল্প নিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে। এনবিআর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পের নির্মাণাধীন ভবন নিয়ে পাঁচটি সুপারিশ দিয়েছে প্রতিবেদনে। প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করছে গণপূর্ত বিভাগ। আইএমইডির প্রতিবেদনে দেয়া মতামত, সুপারিশ বা অভিযোগের বিষয়ে জানতে প্রকল্প পরিচালক ও খুলনা কর অঞ্চলের অতিরিক্ত কমিশনার মু. মহিতুর রহমান গণপূর্ত বিভাগ-২, নির্বাহী প্রকৌশলী, খুলনাকে চিঠি দেয়। চিঠি অনুযায়ী ৯ অক্টোবর প্রকৌশলী মো. আবু জাফর সিদ্দিক জবাব দেন।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুন মাসে প্রকল্পটি সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত। ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক আর্থিক অগ্রগতি মোট প্রকল্প ব্যয়ের ১৯ দশমিক ২৫ শতাংশ। এবং বাস্তব অগ্রগতি ৩০ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রকল্পের অনুক‚লে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ রয়েছে। এরই পরিপ্রক্ষিতে খুলনা কর ভবন নির্মাণসহ আনুষাঙ্গিক কার্যাবলি সম্পন্ন করার লক্ষ্যে প্রকল্পের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, এনবিআর ও প্রকল্প কার্যালয় কর্তৃক মনিটরিং জোরদার করতে হবে। এর জবাবে গণপূর্ত বিভাগ-২, খুলনা থেকে বলা হয়, গণপূর্ত অধিদপ্তর থেকে ‘খুলনা কর ভবন’ নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক কার্যাবলি সম্পন্ন করার লক্ষ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিয়মিত মনিটরিং করা হয়।
আইএমআইডির প্রতিবেদনে প্রকল্পের কাজের মান নিয়ে বলা হয়, নির্মাণকাজে গুণগতমান রক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। নির্মাণকাজে তৃতীয় শ্রেণির ইট ব্যবহার করা হচ্ছে। ফ্লোর স্পর্শ করে সিমেন্ট রাখা হয়েছে। ঢালাইয়ের কাজে স্টিলের শাটারিংয়ের পাশাপাশি কাঠের সাটারিং ব্যবহার করা হচ্ছে। ঢালাই কাজে ব্যবহারের আগে ইট ও পাথর পরিশোধন করা হচ্ছে না। ঢালাই কাজে সঠিকভাবে ভাইব্রেশন প্রদান করা হচ্ছে না। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। এর জবাবে গণপূর্ত বলছে, নির্মাণ কাজের গুণগতমান রক্ষায় নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে। কর ভবন নির্মাণকাজে সুপার স্ট্রাকচারে ‘স্যান্ড সিমেন্ট হোল বøক (এসসিএইচবি)’ এর ওয়াল বিদ্যমান, যার কাজ এখনও শুরু হয়নি। ভবনের সেমি বেজমেন্টে রিটেনিং ওয়ালের সঙ্গে কিছু ইটের গাঁথুনির কাজ আছে। সাইটে অস্থায়ী সোলিং, কাটামাটির ওপর চলাচলের অস্থায়ী রাস্তা ও অন্যান্য কিছু কাজে ইটের ব্যবহার করা হয়েছে, যা মূল ভবনের কাজ নয়। তা সত্তে¡ও সাইটে আনা ইটের মধ্যকার অপেক্ষাকৃত খারাপ ইটগুলো অপসারণ করা হয়েছে। ঢালাই কাজের আগেই যথেষ্ট পরিমাণ পানি দিয়ে পাথর ধুয়ে পরিশোধন করা হয়। ঢালাই কাজে ইটের ব্যবহার নেই। তাই ঢালাই কাজে ইটের পরিশোধন বিষয়টি প্রযোজ্য নয়।
গণপূর্ত আর বলেন, ঢালাই চলাকালে যথাযথভাবে ভাইব্রেটর দিয়ে ভাইব্রেশন করা হয়। ঢালাইয়ের সামান্য কিছু জায়গায় যেখানে রডের পরিমাণ খুব বেশি, সেখানে ভাইব্রেটর ব্যবহার করা কঠিন। তা সত্তে¡ও যথা সম্ভব ভাইব্রেশন করা হয়। এটা ছাড়াও আরসিসি ঢালাইয়ের সময় সাইটের প্রস্তুতকৃত ঢালাইয়ের থেকে যথাযথ নিয়মে কনক্রিট সিলিন্ডার তৈরি করে পরবর্তী সময় কনক্রিটের কমপ্রিসিভ স্ট্রেন্থ টেস্ট করানো হয়। ঢালাই কাজে প্রায় সব জায়গায় স্টিলের সাটার ব্যবহার করা হয়েছে। তবে ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরের ঢালাইয়ের সময় একটি ফ্লোর ভিম ঢালাই করতে হয়, যা এফজিএল থেকে প্রায় ৪-৬ ফুট উপরে। উল্লেখ্য, ৪-৬ ফুট এর স্টিল প্রপস পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে সাপোর্ট হিসেবে বাঁশের প্রপস ব্যবহার করা হয়েছে। পরে ঢালাইয়ে এ ধরনের কোনো জটিলতা না থাকায় সম্পূর্ণরূপে স্টিলের শাটার ব্যবহার করা হয়েছে। ঢালাইয়ের দু-এক দিন আগেই সাইটে সিমেন্ট এনে ঢালাই কাজ করা হয় বিধায় সংরক্ষণের কারণে সিমেন্টের মান খারাপ হওয়ার সুযোগ নেই। পরবর্তী সময় যথাযথভাবে সিমেন্ট ব্যাগ সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ব্যবহƒত সিমেন্ট থেকে স্যাম্পল সংগ্রহ করে টেস্ট করানো হয়েছে, যার ফলাফল সন্তোষজনক। ইটের কাজসহ সব নির্মাণসামগ্রী ও নির্মাণ কাজের গুণগতমান রক্ষায় গণপূর্ত অধিদপ্তর নিবিড়ভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে প্রকল্পের ব্যয়িত অর্থের এক্সটার্নাল অডিট করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রকল্পের ক্রয় পরিকল্পনা ও কর্মপরিকল্পডনা প্রণয়ন ও সে অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
এই বিষয়ে খুলনা কর অঞ্চলের অতিরিক্ত কর কমিশনার (পরিদর্শী রেঞ্জ-১) ও খুলনা কর ভবন নির্মাণ প্রকল্প পরিচালক মু. মহিতুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, আমরা তদারকি করি। তবে এই ধরনের কিছু আমরা পাইনি। এটা দেখার দায়িত্ব গণপূর্তের। তারা আমাদের কাছে বরাদ্দ চায়, আমরা বরাদ্দ দেয়। নি¤œমানের সামগ্রী ব্যবহারের বিষয়ে গণপূর্তের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
সূত্রমতে, সারাদেশে দৃষ্টিনন্দন কর ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয় এনবিআর। এরই অংশ হিসেবে খুলনা কর ভবনের জন্য প্রকল্প নেয়া হয়। ২০১৯ সালের ২০ আগস্ট একনেকে ‘খুলনা কর ভবন নির্মাণ’ প্রকল্প পাস হয়। ৭১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা সরকারি ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের কাজ ওই বছরের জুলাই থেকে শুরু হয়ে ২০২২ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এ প্রকল্পের আওতায় ভবনে থাকবে একটি সেমি বেজমেন্টসহ ১০তলা ভবন নির্মাণ (১২ হাজার ১৬৮ বর্গমিটার)। বিদ্যুতের জন্য ২৫০ কেভিএ সাব-স্টেশন নির্মাণ করা হবে। ভবনে এয়ারকুলার, সোলার সিস্টেম, দুই হাজার ৫০০ বর্গমিটার অভ্যন্তরীণ রাস্তা, ২৯৫ মিটার প্রাচীর নির্মাণ করা হবে। সারফেস ড্রেন নির্মাণ, বহিঃপানি সরবরাহ, বৃষ্টির পানি ধারণ ও সিকিউরিটির ব্যবস্থা থাকবে। নির্মাণ করা হবে ৫০০ আসনের মাল্টিপারপাস হল।