সওজের প্রতিবেদন

নির্মাণের তিন বছরেই ভেঙে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ দুই মহাসড়ক

ইসমাইল আলী: ঢাকা-চট্টগ্রাম-টেকনাফ দেশের প্রধান মহাসড়ক (এন-১)। এ মহাসড়কটির কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম সিটি গেট পর্যন্ত চার লেন করা হয়েছে মাত্র তিন বছর আগে। যদিও মহাসড়কের ২০টি স্থানে রয়েছে ভাঙাচোরা। একইভাবে ২০১৭ সালে শেষ হয়েছে ঢাকা-ময়মনসিংহ (এন-৩) চার লেন প্রকল্পের কাজও। তিন বছরের মধ্যে এ মহাসড়কের ৬০টি স্থানে ভাঙাচোরা দেখা দিয়েছে।

একইভাবে ঢাকা-বরিশাল, ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-রাজশাহীসহ ও অন্যান্য মহাসড়কের অবস্থাও ভালো নয়। যদিও জাতীয় মহাসড়কের চেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়কগুলো। সব মিলিয়ে দেশের সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটারের বেশি সড়ক-মহাসড়ক বর্তমানে ভাঙাচোরা রয়েছে। আর বাকি সড়কের মধ্যে মোটামুটি চলনসই রয়েছে দুই হাজার ৯৩৫ কিলোমিটার।

ভাঙাচোরা এসব সড়ক-মহাসড়ক মেরামতে পাঁচ বছরে দরকার ২০ হাজার ২২৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এর মধ্যে চলতি অর্থবছর দরকার ১৩ হাজার ৮৯৪ কোটি ৯১ লাখ টাকা। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের মহাসড়ক ব্যবস্থাপনা বিভাগের (এইচডিএম) সর্বশেষ সমীক্ষা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

‘মেইনটেন্যান্স অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন নিডস রিপোর্ট অব ২০২০-২০২১ ফর আরএইচডি পেভড রোডস’ শীর্ষক সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এন-১ মহাসড়কে ভাঙাচোরা রয়েছে ১৫২ দশমিক ৪৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১২টি স্থানেই নতুন করে মেরামত করতে হবে, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ১১৭ কিলোমিটার। এছাড়া ৪টি স্থানে ওভারলে ও ৪টি স্থানে পুনর্বাসন করতে হয়। এ অংশগুলো মেরামতে দরকার হবে ৪৮৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বনানী-জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ অংশের ভাঙ্গাচোরা অংশের দৈর্ঘ্য ১১৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার। এগুলো মেরামতে দরকার হবে ২৯২ কোটি ২৭ লাখ টাকা।

সূত্রমতে, সওজের অধীনে সারা দেশে প্রায় ১৯ হাজার ২৮৩ কিলোমিটার পাকা সড়ক-মহাসড়কের ওপর সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়েছে। গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ মাস ধরে এ সমীক্ষা পরিচালনা করেছে সওজের এইচডিএম সার্কেল। এর ভিত্তিতেই প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করা হয়। এতে দেখা যায়, তিন হাজার ৫৯০ কিলোমিটার বা ১৮ দশমিক ৬২ শতাংশ সড়কের অবস্থা খুবই খারাপ। এর মধ্যে এক হাজার ৭১৬ কিলোমিটার পুওর, ৯৩০ কিলোমিটার ব্যাড ও ৯৪৪ কিলোমিটার ভেরি ব্যাড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

সমীক্ষায় বিবেচিত তিন হাজার ৭৪৩ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কের মধ্যে দুই হাজার ৪৩২ কিলোমিটার বা প্রায় ৬৫ শতাংশ ভালো অবস্থায় রয়েছে। মোটামুটি চলনসই অবস্থায় আছে ১৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ জাতীয় মহাসড়ক। বাকি ১৮ দশমিক ১৪ শতাংশ ভাঙাচোরা। সওজের ১০টি জোনের জাতীয় মহাসড়কের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ঢাকা, খুলনা ও রংপুর। আর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জোন।

চার হাজার ৪৩৮ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়কের মধ্যে তিন হাজার ১০৪ কিলোমিটার বা ৭০ শতাংশ ভালো অবস্থায় রয়েছে। আর ১৪ শতাংশ মোটামুটি চলনসই ও ১৬ শতাংশ ব্যবহার অনুপযোগী। আঞ্চলিক মহাসড়কের সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে রংপুর, রাজশাহী ও বরিশাল জোনে। আর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা কুমিল্লা, ঢাকা ও সিলেট জোনের সড়কের। অন্যান্য জোনে মোটামুটি চলনসই এসব সড়ক।

এদিকে ১১ হাজার ১০২ কিলোমিটার জেলা সড়কের মধ্যে সাত হাজার ২২০ কিলোমিটার বা ৬৫ শতাংশ ভালো অবস্থায় রয়েছে। মোটামুটি চলনসই জেলা সড়ক ১৫ শতাংশ। আর ২০ শতাংশ সড়ক অব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা ও কুমিল্লা জোনের।

জানতে চাইলে সওজের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, সওজের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রতি বছর সারা দেশের সব সড়ক-মহাসড়ক পর্যবেক্ষণ করা হয়। এর ভিত্তিতে প্রণীত প্রতিবেদন এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি সড়কগুলো ব্যবহার উপযোগী রাখতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দও চাওয়া হয়েছে। তবে প্রতি বছর বর্ষার আগেই এ প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়। যদিও এ বছর করোনাভাইরাসের কারণে এ কার্যক্রম কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে। এছাড়া এ বছর করোনার কারণে মহাসড়কে গাড়ি চলাচল করছে অনেক কম। ফলে সড়কগুলোর ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে কম।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভাঙাচোরা সড়ক-মহাসড়কগুলো মেরামতে চলতি অর্থবছর বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ১৩ হাজার ৮৯৪ কোটি ৯১ লাখ টাকা। আর পরবর্তী চার অর্থবছর বরাদ্দ লাগবে যথাক্রমে দুই হাজার ৫৫৬ কোটি ৮৫ লাখ, এক হাজার ৯৮৫ কোটি ৩৩ লাখ, এক হাজার ৮৪ কোটি ও ৭০২ কোটি ৩১ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে পাঁচ অর্থবছর বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে ২০ হাজার ২২৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়ক-মহাসড়ক মেরামতে কোনো বছরই প্রয়োজন অনুপাতে বরাদ্দ পায় না সওজ। দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়ে থাকে। ফলে সড়কগুলো ভাঙাচোরা থেকেই যায়।

যদিও শুধু অর্থ ব্যয় করেই সড়ক-মহাসড়কের অবস্থার উন্নতি সম্ভব নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক। তিনি বলেন, এদেশে সড়ক-মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণের ধরনটা খুব খারাপ। প্রতি বছর বর্ষার পর রাস্তা সংস্কারে যেতে হয়। পৃথিবীর আর কোথাও এ সংস্কৃতি নেই। সেখানে ১০-১২ বছর পর সংস্কার হয়। তবে দেশে বছর বছর এ খাতে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। কারণ দুটি জলাবদ্ধতা ও ওভারলোডিং। এ দুটোকে বন্ধ করতে হবে। এটা করা খুব সহজ। তা না হলে যতই অর্থ ব্যয় করা হোক কোনো সুফল মিলবে না।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০