সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: লোকসান কমিয়ে আনতে পতাকাবাহী জাহাজ ‘বাংলার শিখা’-কে স্ক্র্যাব হিসেবে নিলামে তুলছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)। আগামী ২৪ মে এ নিলাম অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে গত চার-পাঁচ বছরে ১০টি জাহাজ নিলামে তুলেছে বিএসসি। বর্তমানে ‘বাংলার শিখা’সহ বিএসসি’র বহরে মাত্র তিনটি জাহাজ রয়েছে। অপর দুটি (‘বাংলার জ্যোতি’ ও ‘সৌরভ’) জাহাজ বর্তমানে ‘বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন’ (বিপিসি)-এর তেল পরিবহনে ব্যবহƒত হচ্ছে। অবস্থা এমনি যে, যে কোনো সময় এ জাহাজ দুটিও অকেজো হয়ে পড়তে পারে। আর এ দুটি অকেজো হয়ে পড়লে জাহাজশূন্য হয়ে পড়বে বিএসসি।
বিএসসি সূত্রে জানা যায়, পঁচিশ বছরের পুরোনো ‘বাংলার শিখা’ থেকে গত দুই বছর ধরে কোনো আয় না হলেও প্রতিমাসে এর পেছনে ব্যয় হচ্ছে ৬০ লাখ টাকা। ফলে বছরে লোকসান দিতে হচ্ছে সাত কোটি টাকারও বেশি। এ অবস্থায় লোকসান কমাতে স্ক্র্যাব হিসেবে বিক্রয়ের জন্য জাহাজটিকে নিলামে তোলা হচ্ছে।
জানা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে বিএসসি’র বহরে ১৩টি জাহাজ ছিল। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে পাঁচটি জাহাজ নিলামে তোলা হয়। এর পরের বছরও আরও পাঁচটি জাহাজ বিক্রি করা হয়।
বিএসসি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর ইয়াহইয়া সৈয়দ শেয়ার বিজকে বলেন, “বিএসসি’র মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে মাদার ট্যাংকার ও সেলুলার কন্টেইনারসহ ২৫ থেকে ৩০টি জাহাজ দরকার হলেও বিগত ২৬ বছরে কোনো জাহাজ কেনা হয়নি। সর্বশেষ ১৯৯১ সালে ‘এমভি বাংলার শিখা’ নামে একটি জাহাজ কেনা হয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে জাহাজ রেখে লাভ নেই। তাই বিক্রির জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। আগামীতে নতুন নতুন জাহাজ বহরে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে বিএসসি ঘুরে দাঁড়াবে।”
বিএসসি’র মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) মো. আলমগীর শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বাংলার শিখা জাহাজটি পরিচালনায় প্রতিমাসে ব্যয় ৬০ লাখ টাকা। অথচ গত দুবছর কোনো ধরনের আয় ছিল না। তাই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে এটি নিলামে তোলা হচ্ছে। এতে প্রতিষ্ঠানের খরচ ও লোকসান উভয়ই কমবে। স্ক্র্যাব হিসেবে ক্রেতারা ১৫ কোটি টাকায় এমনিতে যে কেউ কিনবে।’
এদিকে জাহাজের সংখ্যা কমে আসায় সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে বিএসসি ও দেশীয় জাহাজগুলোর অংশগ্রহণ কমছে। দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৭৫ বিলিয়ন ডলার। আর এ বাণিজ্যের প্রায় ৮২ শতাংশ হয় সমুদ্রের মাধ্যমে হয়। এতে বছরের সমুদ্রে পণ্য পরিবহনে ব্যবসা হয় প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ সংকটের কারণে নামমাত্র বাজার অংশীদারিত্ব আছে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের। ফলে পুরো টাকাটা চলে যাচ্ছে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে।
বিএসসি’র মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) বলেন, ‘সংস্থাটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে পরীক্ষামূলকভাবে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম-মোংলা-চট্টগ্রাম রুটে ফিডার সার্ভিস চালু করা হয়। কিন্তু লোকসানের কারণে ৮ মার্চ ২০১৫ সালে বন্ধ হয়ে যায়। সে থেকে আজ পর্যন্ত জাহাজটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ আছে।’
বিএসসির শীর্ষ কর্মকর্তাদের জানান, সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দেশে বেশ কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে মাসে সাড়ে ৪ লাখ টন কয়লা প্রয়োজন হবে। এ লক্ষ্যে কয়লা পরিবহনে ৮০ হাজার ডিডব্লিউটি সম্পন্ন দুটি নতুন মাদার বাল্ক ক্যারিয়ার এবং ১০ থেকে ১৫ হাজার ডিডব্লিউটি সম্পন্ন বাল্ক ক্যারিয়ার বিদেশি ঋণে কিনতে এরই মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। আরপিও’র মাধ্যমে শেয়ার বিক্রি ও সংস্থার নিজস্ব অর্থে প্রায় ৩৬ হাজার ডিডব্লিউটি সম্পন্ন নতুন একটি কেমিক্যাল, ক্রুড অয়েল ট্যাংকার সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর ক্রয়ের কাজ চলছে। যা আগামী দুই মাসের মধ্যে জাহাজটি বিএসসি’র বহরে যুক্ত হবে।
বর্তমানে বিএসসি’র বহরে দুটি জাহাজ আছে। দুটি দিয়ে কোনো রকমে বাণিজ্যিক কার্যক্রম টিকিয়ে রেখেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার জি-টু-জি ভিত্তিতে চীন সরকারের ঋণের টাকায় তিনটি নতুন প্রডাক্ট অয়েল ট্যাংকার ও তিনটি নতুন বাল্ক ক্যারিয়ার ক্রয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চীনা ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের সঙ্গে জাহাজ নির্মাণে চুক্তিও স্বাক্ষর হয়েছে। এরই মধ্যে প্রথম কিস্তির অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। জাহাজ নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে। আগামী বছরের মে থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বিএসসি’র বহরে জাহাজগুলো যুক্ত হবে। ছয়টি জাহাজের মধ্যে প্রত্যেকটির ধারণক্ষমতা ৩৯ হাজার মেট্রিক টন। জাহাজগুলো বিএসসি’র বহরে যুক্ত হলে পরিবহন ক্ষমতা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে বলে মনে করছেন তিনি। পরিকল্পনা অনুযায়ী জাহাজগুলো বিএসসি’র বহরে যুক্ত হলে সংস্থার আয় বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি সমুদ্রপথে জাহাজে পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।
উল্লেখ যে, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ছয় কোটি ৭২ লাখ টাকা মুনাফা করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)। মুনাফার ওপর শেয়ারহোল্ডারদের ১২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ।