Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 2:53 pm

নিলাম সম্পত্তির ক্রেতা পাচ্ছে না ১১ ব্যাংক: ২৩টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি নিজের নামে করিয়ে নেয় ব্যাংকগুলো

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার দায়ে গত পাঁচ মাসে বন্ধক থাকা ২৩ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি নিলামে তোলে পাঁচ ব্যাংক। কিন্তু ক্রেতা সংকটের কারণে প্রায় এক হাজার ১০০ কোটি টাকার সম্পত্তির একটিও বিক্রি হয়নি। ফলে এসব সম্পদ ব্যাংকগুলো নিজেদের নামে নিবন্ধন করিয়ে নেয়।

ব্যাংক সূত্র জানায়, শিল্প গ্রুপ বা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ঋণ সুবিধা নিয়েছিল। কিন্তু ক্রমাগত লোকসানের কারণে ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। ফলে প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপটির কাছে ব্যাংকগুলোর সুদ-আসলে পাওনা আদায়ে বার বার তাগাদা দেওয়ার পরও ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয় প্রতিষ্ঠানগুলো। এ কারণে ব্যাংকগুলোর কাছে থাকা বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রির ক্ষমতাপ্রাপ্ত এবং অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩-এর ৩৩(৫) ধারা মোতাবেক সনদ পেয়ে ওই জমিগুলো নিলামে বিক্রির প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

গত পাঁচ মাসে ২৩টি নিলাম অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু আগ্রহী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান উপস্থিত না থাকায় ব্যাংকগুলো সম্পদগুলো বিক্রি করতে পারেনি। ফলে এসব বন্ধকি সম্পদ নিজ নামে নিবন্ধন করিয়ে নেয় ব্যাংক। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের ৩৮০ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে তিনটি বন্ধকি সম্পদ ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ৩৫০ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে চারটি সম্পদ নিলামে বিক্রির চেষ্টা করা হয়। এছাড়া এনসিসি ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক নিলামে সম্পদ বিক্রির চেষ্টা করে।

ন্যাশনাল ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, গত মাসের ২৫ জানুয়ারি চট্টগ্রামভিত্তিক বনেদি শিল্পপ্রতিষ্ঠান এমইবি গ্রুপের কাছে পাওনা ২১৬ কোটি ২২ লাখ ২৮ হাজার ৬২২ টাকা ৮৪ পয়সা আদায়ের জন্য পটিয়ায় ১০০ শতক বন্ধকি জমির নিলাম অনুষ্ঠান নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু ক্রেতা সংকটের কারণে ওই জমি বিক্রি করতে পারেনি খাতুনগঞ্জের ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের শাখাটি। পরে তা ব্যাংকের নামে মিউটেশন করা হয়।

একই ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা লিজেন্ড হোল্ডিংসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হাই ঋণের ১৬২ কোটি টাকা পরিশোধ না করায় বন্ধককৃত ১৮ একর ৫৬ শতক জমি চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি নিলামে বিক্রির তারিখ নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কোনো ক্রেতার সাড়া পায়নি। একইভাবে ঋণখেলাপি পোশাক ব্যবসায়ী মৃদুল চক্রবর্তীর কাছে জনতা ব্যাংকের ১১৪ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার দায়ে বন্ধকি সম্পত্তি, জমি ও ফ্ল্যাট নিলামে তোলা হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। কিন্তু কোনো ক্রেতা পাওয়া যায়নি।

মৃদুল চক্রবর্তীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান প্রিটি অ্যাপারেলস, বনবীথি ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড এবং বনলতা গার্মেন্টস লিমিটেডকে পোশাক ব্যবসার প্রয়োজনে ঋণ দেয় চট্টগ্রামের জনতা ব্যাংক লিমিটেড বৈদেশিক বিনিয়ম শাখা। কিন্তু সে ঋণ পরিশোধ করেননি এ ব্যবসায়ী।

এদিকে চলতি মাসের ২৪ তারিখে নিলামের দিন ধার্য করে একাধিক জাহাজভাঙা ও আবাসন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা মিজানুর রহমান শাহিনের কাছে গত ২০ মার্চ পর্যন্ত সুদসহ মোট পাওনা ১৯৭ কোটি ৬১ লাখ টাকার বিপরীতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও ঢাকার বাড্ডায় এক হাজার ৭৪০ ডেসিমাল জমি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার দায়ে নিলামে তুলেছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা। এতে আগ্রহীদের ব্যাংকের শাখাপ্রধানের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বলা হলেও ক্রেতা পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

এ প্রসঙ্গে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ইভিপি এবং আঞ্চলিক প্রধান ও আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক মাহিববুল করিম শেয়ার বিজকে বলেন, আমরা বার বার যোগাযোগ করলেও মিজানুর রহমানের কোনো সাড়া পাইনি। নিয়মানুসারে আমরা সম্পদ নিলামে তুলেছি। যদি ক্রেতা পাই, তাহলে বিক্রি করবো। না হলে ব্যাংকের নামে নিবন্ধন করিয়ে নেবো। আমরা আমাদের প্রক্রিয়া অনুসরণ করবো।

ন্যাশনাল ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপক শাহাদাত হোসেন এ বিষয়ে শেয়ার বিজকে বলেন, ঋণ সুবিধা গ্রহণ করলেও প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করছে না। বার বার তাগাদা দেওয়ার পরও ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর বন্ধকি সম্পত্তি নিয়ম রক্ষার্থে নিলামের আয়োজন করি। কিন্তু কোনো আগ্রহী গ্রাহক বা প্রতিষ্ঠান বন্ধকি সম্পদ কেনার প্রস্তাব দেয়নি। ফলে এসব সম্পদ ব্যাংকের মালিকানায় নেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, অনেক সময় পাওনার চেয়ে সম্পদের মূল্য কম হয়। এতে ব্যাংকগুলোকে লোকসানের সম্মুখীন হতে হয়।

এ ব্যাপারে একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কেউ কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হননি।

ব্যাংকারদের মতে, চট্টগ্রামে এক ব্যবসায়ীর সম্পদ আরেক ব্যবসায়ী কিনতে চান না। কেননা, এক ব্যবসায়ী আরেক ব্যবসায়ীকে ভালো করে চেনেন, জানেন। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা অনেক কৌশল অবলম্বন করেন। এছাড়া হস্তান্তর জটিলতার কারণে কেউ আগ্রহও দেখান না। পাশাপাশি এখন তো কেউ জমি কিনতে চান না। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ক্রমাগত লোকসান ও আর্থিক সংকটে দেনা পরিশোধের লক্ষ্যে ২০০৮ সালে কারখানা বিক্রির জন্য ইস্টওয়েস্ট কনটেইনার টার্মিনালস লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তিনামা দলিল করে সালেহ কার্পেট মিলস লিমিটেড।

এরপর সোনালী ব্যাংক, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশসহ প্রতিষ্ঠানটির অন্য পাওনাদারদের প্রায় ৫৯ কোটি টাকা পরিশোধ করে ইস্টওয়েস্ট কনটেইনার। আর বাকি ৩১ কোটি টাকা সময়মতো পরিশোধ না করায় এখন প্রতিষ্ঠানটির কাছে সুদসহ ব্যাংকের মোট পাওনা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮২ কোটি টাকা। এ কারণে ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কয়েকশ কোটি টাকা দেনা পরিশোধ না করায় এখন প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা হস্তান্তর নিয়েও দেখা দিয়েছে জটিলতা।