শেয়ার বিজ ডেস্ক: ইউক্রেনে হামলার কারণে রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো। নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোয় থাকা রাশিয়ার আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকগুলো এবং দেশটির আলিগার্করা বা ধনী শাসকরা। নিষেধাজ্ঞার আওতায় ব্যাংক ও ব্যক্তিদের সব সম্পদ জব্দ করা হবে এবং নিষিদ্ধ করা হবে তাদের কার্যক্রম। এছাড়া রাশিয়ার অর্থনীতিকে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। এর বাইরে জার্মানি রাশিয়ার গ্যাস পাইপলাইনের (নর্ড স্ট্রিম ২) কাজ বন্ধ করে দেবে। বিশ্বের প্রধান আর্থিক লেনদেন পরিষেবা সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) থেকেও রাশিয়াকে বাদ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাজ্যসহ ইইউভুক্ত কয়েকটি দেশ।
এসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে রাশিয়ার অর্থনীতির ক্ষতি হবে। দেশটির বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অচল হয়ে যাবে বলে মনে করছে প্রতিপক্ষ দেশগুলো। তবে সর্বসাম্প্রতিক এই নিষেধাজ্ঞাগুলোসহ রাশিয়া প্রায় আট বছর ধরে (ক্রিমিয়া দখলের পর থেকে) আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় অভ্যস্ত। ২০১৪ সাল থেকে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা সামলে অর্থনৈতিকভাবে নিজস্ব পথে হাঁটছে দেশটি। উপরন্তু ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়া বর্তমান নিষেধাজ্ঞার জবাবে দেশটিতে থাকা বিদেশি নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানের অর্থ জব্দের ঘোষণা দিয়েছে। এতে বোঝা যায়, সামরিক শক্তির পাশাপাশি অর্থনৈতিক যুদ্ধেও নিজেদের প্রস্তুত করেছে তারা। তাই অর্থনৈতিক যুদ্ধের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ ও অন্যান্য অঞ্চলে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদ রাশিয়া জাতীয়করণ করার চিন্তা করছে।
সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞাগুলোর মধ্যে সুইফট থেকে রাশিয়াকে বাদ দেয়া বড় করে দেখা হচ্ছে। বর্তমানে সুইফটের মাধ্যমে প্রতিদিন কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যমানের আর্থিক লেনদেনের চুক্তি সম্পন্ন হয়। এ সেবা থেকে বাদ পড়লে সাধারণ লেনদেনগুলো সরাসরি ব্যাংকগুলোর মধ্যে পরিচালনার প্রয়োজন পড়বে। লেনদেন পরিচালনার নতুন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, যাতে অতিরিক্ত খরচ ও সময় লাগবে। তবে রাশিয়ার বার্তা সংস্থা তাসের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সুইফট সামলাতে রাশিয়া বিকল্প লেনদেন ব্যবস্থা গড়ে তুলছে। তাই সুইফট থেকে বাদ পড়লে রাশিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যে তেমন গুরুতর প্রভাব পড়বে না। সুইফটের পরিবর্তে একই ধরনের নিজস্ব লেনদেন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে চীন। রাশিয়া যদি এরই মধ্যে বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে নাও তোলে, তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের কিপস (ক্রস-বর্ডার ইন্টার-ব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম) সিস্টেমের ব্যবহার বাড়বে। এ কারণে বিশ্বব্যাপী রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে মার্কিন ডলারের স্থিতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অর্থাৎ সুইফটের ধাক্কা সামলে উঠতে পারবে রাশিয়া।
এরপর রয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিষেধাজ্ঞা। নিঃসন্দেহে এতে রাশিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিদেশি সম্পদের একটি ওয়ার চেস্ট বা সমর তহবিল গড়ে তুলেছে, যা দেশটির অর্থনীতিকে কয়েক মাস চাঙ্গা রাখতে পারবে। বিশ্লেষকরা সব দিক বিবেচনা করে জানান, রাশিয়াকে ‘নিষেধাজ্ঞা-প্রতিরোধী’ করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন পুতিন। তার নেতৃত্বে দীর্ঘদিন ধরে দেশটির পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টরে ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়েছে। অন্তত এক দশকের বেশি ধরে রাশিয়া তার অভ্যন্তরীণ ঋণদান ব্যবস্থায় সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে সীমিত আকারে ঋণ দিয়েছে। এই সাবধানী পদক্ষেপে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জমিয়েছে বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক সম্পদের সঞ্চয়। এছাড়া রাশিয়া তার বাজেটেও কাটছাঁট করে এনেছেÑপ্রবৃদ্ধির বদলে তারা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ফলে রাশিয়ার অর্থনীতি গত এক দশকে প্রতি বছর গড়ে এক শতাংশের কম হারে বেড়েছে। এই প্রক্রিয়ায় দেশটি অতীতের তুলনায় বেশি আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছে।
এছাড়া মস্কোর কাছে বৈদেশিক মুদ্রার পর্যাপ্ত রিজার্ভ রয়েছে, যার বেশিরভাগ আয় আসে স্বর্ণ থেকে। এর পরিমাণ এখন ৬৩ হাজার ৬০ কোটি ডলার, যা ক্রিমিয়া দখলের পর ৬০ শতাংশ বেশি। বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে কয়েক বছর নিজেকে সব ধরনের ঝামেলা থেকে দূরে রাখতে পারবে দেশটি। বিশ্বের সব দেশের তুলনায় রাশিয়ার এই রিজার্ভ চতুর্থ বৃহত্তম, যা রুশ মুদ্রা রুবলের পতন ঠেকিয়ে একে চাঙ্গা রাখতে দীর্ঘদিন পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে। বর্তমানে রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার মাত্র ১৬ শতাংশ রয়েছে ডলারে। এভাবে ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে এমন এক রুশ অর্থনীতি গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে, যার ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়বে না। দেশটি বৈদেশিক ঋণ ও বিনিয়োগের ওপরও তাদের নির্ভরতা কমিয়েছে।
ইইউতে ৩০০ বিলিয়ন ইউরো মূল্যমানের রুশ সম্পদের মালিকানা রয়েছে। তাই রাশিয়ার বিরুদ্ধে যদি পুরোদমে অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে ওই বিপুল পরিমাণ সম্পদও জব্দ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। তাছাড়া যুক্তরাজ্যের কাছে আরও বেশ কয়েক বিলিয়ন ডলারের সম্পদের মালিকানা রয়েছে। বর্তমান নিষেধাজ্ঞার ফাঁকফোকর দিয়ে রুশ দুর্নীতিবাজ নেতারা ঠিকই ইইউ দেশগুলোর অর্থনৈতিক বাজারে বিচরণ করতে পারছেন। অবৈধ রুশ অর্থের প্রবেশ ঠেকাতে ব্যর্থ এসব দেশ। প্রসঙ্গত, বরিসের কনজারভেটিভ পার্টির অন্যতম অর্থের উৎস রাশিয়ার আলিগার্করা। শুধু যুক্তরাজ্য নয়, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ফিনল্যান্ড, সুইডেনসহ ইইউর আরও অনেক দেশের সাবেক রাষ্ট্রপ্রধানদের পকেটে রয়েছে রাশিয়ার তেল-গ্যাসের অর্থ। অর্থনৈতিক অবরোধ দেয়া হলে তারাই রাশিয়ার পাশে দাঁড়াবে। পাশে থাকবে ব্রিকস দেশগুলোও।
সূর্যমুখী তেল, ভুট্টা, গম প্রভৃতি খাদ্যপণ্যসহ অপরিশোধিত তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও কঠিন জীবাশ্ম জ্বালানির বড় সরবরাহকারী রাশিয়া। রুশ তেল ও গ্যাস কেনার ওপর এখনও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি। এক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলে রাশিয়াকে বেকায়দায় ফেলা যাবে। ইইউ নিষেধাজ্ঞা দিলে এসব পণ্যের বিকল্প জোগানদাতা খুঁজে পাওয়া কঠিন হতে পারে। তবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে রুশ ফার্মগুলোর মতো তাদের মিত্রদেরও ক্ষতি হতে পারে। রুশ সরবরাহ ছাড়া ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম ১৪০ ডলারের মধ্যে রেখে কাজ চালানোর মতো বাড়তি তেল থাকলেও রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করার ফলে গ্যাসের যে সংকট সৃষ্টি হবে, তা নিরসনের কোনো উপায় নেই। গ্যাসের যে ঘাটতি দেখা দেবে, তা মেটাতে ইইউ গ্যাস রেশন করতে বাধ্য হবে। এতে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে ৯ গুণ বেড়ে যাবে দাম, দেখা দেবে তেল সংকট। অর্থাৎ রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলে বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কেননা ইইউসহ কয়েকটি দেশের উৎপাদিত পণ্যের বড় ক্রেতা রাশিয়া। বৈশ্বিক একটি পরাশক্তি হিসেবে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রভাব বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর নানাভাবে পড়বে।