রোহান রাজিব: দেশের ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা করে থাকে। তবে মামলা করেও অর্থ আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। গত জুন পর্যন্ত এক লাখ ৫৫ হাজার ৮৮৮টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় জড়িত অর্থের পরিমাণ ছিল ৯২ হাজার ২১২ কোটি টাকা। যদিও নিষ্পত্তীকৃত অর্থের অর্ধেকও আদায় করতে পারেনি ব্যাংকগুলো। এখন পর্যন্ত নিষ্পত্তীকৃত মামলার বিপরীতে মাত্র ২৩ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা আদায় হয়েছে, যা খেলাপি পাওনার মাত্র ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়ার সময় কাগজপত্রে জামানত বেশি দেখিয়েছে। পরে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে গেছে, কিংবা মালিক মারা গেছেন, তখন আর ঋণ আদায়ের সুযোগ থাকে না। তারা যে জামানত রেখে যান, তা বিক্রি করে ব্যাংক পুরো অর্থ পায় না। তাই মামলা নিষ্পত্তি হলেও ব্যাংক অর্থ আদায় করতে পারে না।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৩ সালে অর্থঋণ আদালত গঠন হওয়ার পর থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এ আদালতে মামলা হয়েছে মোট দুই লাখ ২৮ হাজার ৪২৮টি। এসব মামলায় জড়িত অর্থের দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৭০ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকায়। গত ডিসেম্বর শেষে মামলার স্থিতি ছিল দুই লাখ ২২ হাজার ৩৪৮টি। এর বিপরীতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৪৯ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসের ব্যবধানে মামলা বেড়েছে ছয় হাজার ৮০টি আর দাবিকৃত অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ২১ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা।
গত জুন পর্যন্ত এক লাখ ৫৫ হাজার ৮৮৮টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় জড়িত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯২ হাজার ২১২ কোটি টাকায়। এখন পর্যন্ত দাবির বিপরীতে আদায় হয়েছে মাত্র ২৩ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নিষ্পত্তি মামলার পরিমাণ ছিল এক লাখ ৫০ হাজার ১৫৯টি। এসব মামলায় ৮২ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা দাবি ছিল। ওই সময় পর্যন্ত দাবির বিপরীতে আদায়ের পরিমাণ ছিল মাত্র ২১ হাজার ৮২ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসে মামলা নিষ্পত্তি বেড়েছে পাঁচ হাজার ৭২৯টি। দাবির পরিমাণ বেড়েছে ৯ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা। ছয় মাসে আদায় বেড়েছে দুই হাজার ২৪৬ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক শেয়ার বিজকে বলেন, আদালতের রায় অনুযায়ী ব্যাংকগুলো অর্থ আদায়ে চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতার পর্যাপ্ত জামানত বিক্রি করেও যদি অর্থ আদায় না করা যায়, তবু ঋণগ্রহীতাকে পুরো অর্থ অন্য কোনো পন্থায় পরিশোধ করতে হবে।
বর্তমানে অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় মামলা রয়েছে ৭২ হাজার ৫৪০টি। এসব মামলার বিপরীতে দাবির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৭৮ হাজার ২৭৭ কোটি টাকায়। গত ডিসেম্বর শেষে বিচারাধীন মামলার পরিমাণ ছিল ৭২ হাজার ১৮৯টি। এর বিপরীতে দাবির পরিমাণ ছিল এক লাখ ৬৬ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসে বিচারধীন মামলা বেড়েছে ৩৫১টি আর অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ১১ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১৪ হাজার ৪৮০টি। এতে পাওনা অর্থের পরিমাণ ৭৫ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। আর বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর অর্থঋণ আদালতে চার হাজার ৯৩৩টি মামলা বিপরীতে দুই হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা পাওনা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ৪৪ হাজার ৬০৫টি মামলায় ৯৫ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা পাওনা এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর আট হাজার ৫২২টি মামলার বিপরীতে তিন হাজার ৯১৯ কোটি টাকা পাওনা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্যানেল আইনজীবী মো. রুহুল আমিন ভূঁইয়া শেয়ার বিজকে বলেন, অর্থঋণ আদালতের পুরো বিচার প্রক্রিয়াটাই দীর্ঘমেয়াদি। মামলা নিষ্পত্তিতে সময় লাগার অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে যে কারণগুলো সব মামলার ক্ষেত্রে বলা যায়, সেটা হচ্ছে সমন জারিতে অনেক সময় লাগে। বিবাদী পক্ষ নিন্ম আদালত থেকে মামলা উচ্চ আদালতে নিয়ে যায়। উচ্চ আদালতে মামলাজট থাকায় শুনানিতে দেরি হয়। আবার অনেকে রিট মামলা করেন। রিটের চূড়ান্ত শুনানিতেও দীর্ঘদিন লেগে যায়।
তিনি আরও বলেন, অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হলেও অর্থ না আদায় হওয়ার কারণ হলো বড় গ্রাহকদের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই না করা। এতে ঋণের ক্ষেত্রে যেসব জামানত কাগজপত্রে দেখানো হয়, তা বাস্তবে নেই। ফলে মামলা নিষ্পত্তি হলেও ব্যাংক অর্থঋণ আদায় করতে পারে না। আর এসবই হচ্ছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে। এছাড়া মালিক পক্ষ ঋণ নিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। তখন কর্মকর্তারা বাধ্য হয়ে ঋণ দেন। ব্যাংক খাতের জন্য এটা বড় সমস্যা।