নাজমুল হুসাইন: জাতীয় ওষুধ নীতিমালা প্রণয়ন হয়েছে গত মাসে। এতে আগের মতো শুধু অ্যালোপ্যাথিকই নয়, অন্তর্ভুক্ত হয়েছে হোমিওপ্যাথিকসহ আয়ুর্বেদ, ইউনানি ও হারবাল ওষুধকেও। ফলে এসব ওষুধ তৈরি, বিক্রি ও আমদানিতে প্রয়োজনীয় বাধ্যবাধকতা আনা হয়েছে। সব ধরনের ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে এ নীতিমালার আওতায়।
এতদিন ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ও ওষুধ প্রশাসন পরিদফতর ওষুধের নিয়ম-নীতিগুলো দেখভাল করতো। আর অ্যালোপ্যাথিক ছাড়া অন্য পদ্ধতির প্রতিষেধকগুলো তদারকির বাইরেই রয়ে যেতো। ফলে ওইসব ওষুধের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের অনিয়ম চলে আসছে। ভেষজ বা আয়ুর্বেদের নামে নানা ধরনের ক্ষতিকর ও ভেজাল ওষুধে বাজার ছেয়ে আছে। আবার ওষুধের দামেও নেই কোনো সামঞ্জস্য। অন্যদিকে কোনো নীতিমালা না থাকায় এসব বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোর প্রসারও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
নতুন নীতিতে সব ওষুধে এখন পৃথকভাবে নিবন্ধন করতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে। এছাড়া নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ প্রস্তুত, বিক্রি ও বিতরণ রোধে আইনের সংস্করণের কথাও বলা হয়েছে। ওষুধ সংগ্রহ, উৎপাদন, মজুত ও বিক্রিতেও রয়েছে নির্দেশনা। সঙ্গে স্বচ্ছ ও যৌক্তিকভাবে সরকারের ওষুধের মূল্য নির্ধারণ, নতুন প্রযুক্তি, ওষুধ গবেষণা উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়েও বলা হয়েছে এ নীতিমালায়।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘নতুন ওষুধনীতি জনবান্ধব। এ নীতিতে প্রথমবার সব ধরনের ওষুধের নকল-ভেজাল বন্ধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধকে তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক ওষুধকে। ৬৯৩টি ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক এ তালিকায় রাখা হয়েছে। এতে সবাই উপকৃত হবেন।’
তিনি বলেন, ‘এসব ট্র্যাডিশনাল চিকিৎসাপদ্ধতির প্রতি জনগণের অনেকাংশের আগ্রহ রয়েছে। এসব পদ্ধতিকে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবায় কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ আগে সেভাবে নেওয়া হয়নি। এবার তাদের এগিয়ে আসার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে এসব খাতের যেমন জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে, তেমন খাতগুলোও উপকৃত হবে।’
এ নীতিমালায় আয়ুর্বেদিক, ইউনানি, হারবাল, হোমিওপ্যাথিক ও বায়োকেমিক ওষুধের মানোন্নয়নে ও এসব উৎপাদনে নিয়ন্ত্রণ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ড্রাগ লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ নিবন্ধিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। যাতে কেবল ইউনানি, আয়ুর্বেদ ও হোমিওপ্যাথিক ফর্মুলারি/ফার্মাকোপিয়ার অন্তর্ভুক্ত ওষুধগুলোর নিবন্ধন বিবেচনা করা হবে।
এছাড়া সব ধরনের ওষুধ আমদানির ক্ষেত্রেও বিধান যুক্ত করা রয়েছে। হারবাল ও হোমিওপ্যাথিক-বায়োকেমিক ওষুধ আমদানি করতে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর কর্তৃক আমদানিকারক হিসেবে নিবন্ধিত হতে হবে। আর দেশি ভেষজ হতে উদ্ভূত হওয়ায় ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ আমদানি করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিভিন্ন পদ্ধতির এসব ওষুধের দাম সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হবে। এছাড়া সব ওষুধের যথাযথ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিক্রির জন্য নিবন্ধিত চিকিৎসক অথবা নিবন্ধিত ফার্মাসিস্টের তত্ত্বাবধানে ফার্মেসি পরিচালনা করতে হবে। আর ওষুধ উৎপাদনকারী হতে হলে সে বিষয়ভিত্তিক স্নাতক ও ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী, মাইক্রোবায়োলজি, ফার্মেসি, বোটানি, কেমিস্ট্রি, বায়োকেমিস্ট্রি এবং অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রিধারী প্রয়োজনীয়সংখ্যক মান নিয়ন্ত্রণ এবং উৎপাদন কর্মকর্তা রাখতে হবে।
বাজারে আয়ুর্বেদিক, ইউনানি, হোমিওপ্যাথিক ও হার্বাল ওষুধের ক্ষেত্রে এখন থেকে জেনেরিক নামের পাশাপাশি ওষুধের প্রকার সুস্পষ্টভাবে করতে বলা হয়েছে। এসব ওষুধ উৎপাদনে কোনো অননুমোদিত রাসায়নিক উপাদান (যেমন স্টেরয়েড, হরমোন, যৌন উত্তেজক অথবা অন্য কোনো রাসায়নিক উপাদান) ব্যবহার করা যাবে না। এছাড়া এসব ওষুধে এফডিসি কালার বা সার্টিফাইড ফুড/ফার্মা গ্রেডের কালার ব্যতীত অন্য কোনো কালার বা ফ্লেভার ব্যবহার করা যাবে না। অ্যালকোহলযুক্ত হোমিওপ্যাথিক শক্তিকৃত ওষুধ হলে তার প্যাক সাইজ ৩০ মিলিলিটারের বেশি করা যাবে না বলে বলা হয়েছে নীতিমালায়।
সরকারের পক্ষ থেকে ইউনানি, আয়ুর্বেদিক, হার্বাল ও হোমিওপ্যাথিক-বায়োকেমিক ওষুধের জন্য বিশেষায়িত আধুনিক পরীক্ষাগার স্থাপন করা হবে। এসব পরীক্ষাগারে সব ওষুধ পরীক্ষার জন্য পৃথক পৃথক সেল সৃষ্টি করা হবে। মানদণ্ডের জন্য তৈরি হবে পাঁচ বছরের জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন জিএমপি নীতিমালা। যা ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত হবে।
সব ধরনের নিম্নমান, নকল, ভেজাল ও নিবন্ধনবিহীন ওষুধ এবং ফুড সাপ্লিমেন্টের নামে ওষুধজাতীয় পণ্যের অননুমোদিত উৎপাদক ও বিক্রেতা, ব্যবস্থাপত্র প্রদানকারী চিকিৎসক ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করতে বিদ্যমান আইনের সংস্কার করা হবে বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।