Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 1:04 pm

নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতায় অসহায় বোধ করে মধ্যবিত্ত

কবির সাহেব একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ৩০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। বাড়িভাড়া, চিকিৎসা, দুটি সন্তানদের লেখাপড়া সব মিলিয়ে একধরনের টানাটানিতেই চলে সংসার। তারপর কর দিতে হয় প্রতি বছর।

কবির সাহেব ভাবেন, দেশের ১০ শতাংশ লোক এক-তৃতীয়াংশ সম্পদের মালিক। আর বিবেচনাহীন শুল্ক ও করনীতির কারণে রাষ্ট্রের কোষাগারের বড় জোগানদার দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সরকারের রাজস্ব আয় প্রধানত পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। ২০১৫-১৬ সালে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণে মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট) ওপর নির্ভর করতে হয়। ভ্যাট ও শুল্ক পরোক্ষ কর। এটা চাপে মূলত কবির সাহেবের মতো সাধারণ ভোক্তাদের ঘাড়ে। আয়কর নীতি এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে প্রকৃতপক্ষে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপরই এর চাপ বহাল থাকে। এদিকে বিত্তশালীরা স্বল্প হারে কর দিচ্ছেন। তাছাড়া তাদের জন্য রেয়াত বহুবিধ।

দেশের ধনিক শ্রেণি মূলত তৈরি পোশাকশিল্পের সঙ্গেই জড়িত। পোশাক রফতানিকালে নস্যি পরিমাণ কর নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তিকৃত বলে গণ্য হয়। আবার এই ধনিক শ্রেণি টাকা সাদা করতে অনেক অর্থ বিনিযোগ করেন শেয়ারবাজারে। যেখানে কার্যত কোনো করই নেই। এ অবস্থা চলছে অনেক খাতেই। সুতরাং আয়কর বাবদ তাদের অবদান খুব কম, এমনটা বলা চলে। কবির সাহেবের চিন্তার বিষয় ক্রমেই বাড়ে।

আয়করের হিসাবটা একটু তলিয়ে দেখলে স্পষ্ট হবে, এর বোঝাটা কীভাবে মধ্যবিত্তের ওপর চাপানো হয়েছে। বছরে আড়াই লাখ টাকার ওপর আয় হলেই কর। আর সাড়ে ১৭ লাখের বেশি হলে তা ২৫ শতাংশ। সাড়ে ৪৭ লাখ টাকার উপর হলে ৩০ শতাংশ। এটাই সর্বোচ্চ। অথচ সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বেশি আয়ের লোকদের ওপর ৫০ শতাংশ করারোপ কি অযৌক্তিক? এমনটা আছে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে। করমুক্ত আয়সীমাও সেখানে অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে ৯ হাজার ২২৫ ডলার আর যুক্তরাজ্যে ১১ হাজার পাউন্ড।

অনেকটা আমাদের কাছাকাছি ভারতের অবস্থান। তবে সেখানে দরিদ্র শ্রেণির জন্য একটা জোরালো নিরাপত্তাবলয় রয়েছে। ইউরোপের দেশগুলো ও যুক্তরাষ্ট্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম সেখানকার মানুষের আয়ের অনুপাতে খুব কম। কম দামে তারা কিনতে পারেন চাল, রুটি, চিনি, মুরগি, ডিম, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য। উৎপাদক পর্যায়ে ভর্তুকি দিয়ে আর বাজার নিবিড় তদারকির মাধ্যমে তারা ভোক্তাদের এ সুযোগ নিশ্চিত করছে। আমাদের দেশে কি তা সম্ভব?

বর্তমানে চালু অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি কার্যত বিলুপ্ত হতে চলেছে। এদের একটি ক্ষুদ্র অংশ উচ্চবিত্ত কিংবা উচ্চমধ্যবিত্তের কাতারে স্থান নিচ্ছে। অনেকেই যাচ্ছে নি¤œবিত্তের কাতারে। অথচ মধ্যবিত্ত শ্রেণি একটি সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি যতো বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ হয়, ততো শক্তিশালী হয় সে সমাজের ভিত। স্থিতিশীল থাকে সমাজব্যবস্থা। সমৃদ্ধি হয় টেকসই। এ ধরনের একটি সমাজব্যবস্থা গড়তে আবশ্যক সুশাসন। দেশের শাসনব্যবস্থায় যারা থাকেন, তারা এসব বিষয় বিবেচনায় না নিলে সামাজিক অস্থিতিশীলতাসহ নানা সমস্যার শঙ্কা থাকে। তবে যারা এটা করবেন, তাদের শ্রেণিচরিত্র এখানে গুরুত্বপূর্ণ।

রাষ্ট্রের ধনিক শ্রেণি কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকায় রয়েছে। তবে দুর্বল শাসনব্যবস্থার জন্য নিজেদের স্বার্থে বঞ্চিত করছে সাধারণ মানুষকে। ব্যক্তি ও সামষ্টিক উভয় দিক দিয়ে এটা প্রযোজ্য। শাসনব্যবস্থায় তাদের ব্যাপক প্রভাব।

আশার কথা, বাংলাদেশ সরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে ক্রমবর্ধমান হারে। অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তাবলয়েরও বিকাশ ঘটছে। সামাজিক খাতে বাংলাদেশের এ বিনিয়োগ দক্ষিণ এশিয়ায় উল্লেখ করার মতো। তবে এর সুফল ভোগ করতে হলে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় বিনিয়োগ বাড়লেও শিক্ষার মান নি¤œমুখী। স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের যথাযথ সুফলও সাধারণ মানুষ ভোগ করছে না। অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তাবলয়েরও বণ্টনব্যবস্থায় বড় গলদ রয়েছে। এগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারলে আয়বৈষম্য কমে যাবে বলে আশা করা যায়। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে কর ও জিডিপির অনুপাত আমাদের দেশে খুব কম। বর্তমানে মাত্র ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। আয়বৈষম্য কমাতে হলে এটাও আরও বাড়ানো দরকার। আয়কর খাত ঢেলে সাজিয়ে প্রকৃত উচ্চ আয়ভোগীদের থেকে যৌক্তিক পরিমাণে আয়কর আদায় করা উচিত। আমাদের রাষ্ট্রের প্রকৃতি গণতান্ত্রিক। এখানে জাতীয় সংসদে শ্রেণিগত প্রতিনিধিত্ব বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, স্বাধীনতার আগে ব্যবসায়ীদের অনুপাত ছিল ১০ শতাংশের নিচে। ১৯৭৯ সালে তা হয়ে যায় ২৮ শতাংশ। এখন ৫০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তাদের শ্রেণিচরিত্রের প্রভাব রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রতিফলিত হবে, এটা স্বাভাবিক। আর তা হচ্ছেও। তারা যেহেতু রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের মূল ভূমিকায়, তাই রাষ্ট্রের কর, রাজস্ব নির্ধারণসহ অন্যান্য আর্থিক সুবিধা নিজেদের অনুকূলে নেওয়ার ব্যবস্থা সহজেই করতে পারেন। ফলে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে ধনী ও দরিদ্রের আয়ের বৈষম্য। বিষয়টির অশুভ প্রভাব সমাজে পড়তে শুরু করেছে। কবির সাহেব লক্ষ করেছেন, প্রবৃদ্ধি বাড়ার পাশাপাশি বৈষম্যও বাড়ছে। এ নিয়ে নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতায় অসহায় বোধ করেন তিনি।

 

এ্যারিয়েন স্ট্যালিন