নীতি প্রণয়নে গবেষণায় গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে অর্থনৈতিক বিষয়াবলিতে নীতিনির্ধারকরা অনুমান ও উচ্চাভিলাষী হয়ে অনেক নীতি প্রণয়ন করে থাকেন। অথচ প্রামাণ্য তথ্য-উপাত্ত ও গবেষণার ভিত্তিতেই নীতি নির্ধারণ করা উচিত। যেকোনো নীতির সঙ্গে বৈশ্বিক অবস্থার সমন্বয়ও থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশের নীতিগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া হয় বলেই তার সঙ্গে প্রামাণ্য গবেষণার প্রতিফলন থাকে না। এটিই দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির চিত্রকে সংশয়াপন্ন করছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) একটি গ্রন্থ উম্মোচন অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেছেন। গতকাল বেসরকারি গবেষণা সংস্থাটির বনানীর কার্যালয়ে ড. সাদিক আহমেদের রচিত ‘বাংলাদেশে প্রমাণভিত্তিক নীতি প্রণয়ন’ শীর্ষক এ গ্রন্থটির উম্মোচন করা হয়। পিআরআই অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান। পিআরআই চেয়ারম্যান ড. জায়েদী সাত্তার এতে সভাপতিত্ব করেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. মশিউর রহমান বলেন, নীতি নির্ধারণে গবেষণার গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রে প্রামাণ্য গবেষণার মাধ্যমে নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে অনেক সময় দেখা যায় প্রামাণ্য নীতি ও সুপারিশ পেতে এতটাই দেরি হয়ে যায় যে তখন আর কাজে লাগে না। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য উন্নত বিশ্বে কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। সেই সুবিধা নিতে দেশের উদ্যোক্তারা কিছু ব্যবসা শুরুর কথা যখন বললেন, তখন এ নিয়ে গবেষণা করতে বলা হলো। দেখা গেল তিন বছর গবেষণায় বলা হয়েছে ভারত, চীনসহ অনেক দেশ এ সুবিধা নিচ্ছে, আমরা নিতে পারিনি। এমন গবেষণা অনেক সময় কাজে লাগে না। তাছাড়া অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ও হয় না।

গ্রন্থ উম্মোচন অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সাবেক তত্ত্বাবধায় সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফা কে মুজেরি, সাবেক সচিব জাকির আহমেদ খান, সানেপের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান প্রমুখ।

এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, একই সঙ্গে অর্থনীতির গবেষক এবং কিছু সময়ের জন্য নীতিনির্ধারক হিসেবে সরকারের সঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, নীতি নির্ধারণে প্রামাণ্য অভিজ্ঞতার গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তবে গবেষণার ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। অনেক ক্ষেত্রেই গবেষকদের গবেষণায় পরস্পরবিরোধী সুপারিশ থাকে, যা নীতিনির্ধারকদের অনাগ্রহী করে। এছাড়া নীতিনির্ধারণ ও গবেষণার সমন্বয়ের জন্য ভালো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন। এজন্য তিনি প্রয়োজনীয় নীতির প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দক্ষতা বৃদ্ধির সুপারিশ করেন। পাশাপাশি গবেষণা শিল্প বা উদ্যোগগুলোর সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে সংযোগ স্থাপন জরুরি বলে তিনি মত দেন।

সাবেক সচিব জাকির আহমেদ খান বলেন, অনেক গবেষণা হয়। কিন্তু আমাদের যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা অনেকেই সেসব গবেষণা পড়েন না। সরকারের যেসব কমিশন হয়, সে কমিশনের প্রতিবেদনগুলোই তো অনেকে পড়ে দেখেন না। এ অবস্থায় গবেষণার প্রতিফলন হবে কীভাবে। তবে তিনি বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাবকে কমিয়ে দেশি বিশেষজ্ঞদের গবেষণার প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান নীতিনির্ধারকদের। তিনি বলেন, দেশেই এখন অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যারা নীতি নির্ধারণে বড় ধরনের প্রামাণ্য সুপারিশ হাজির করতে পারেন।

ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, আসলে অর্থনীতিবিদদের বিপুল গবেষণার মধ্য থেকে সামান্যই কাজে লাগছে। এখন প্রশ্ন সৃষ্টি হচ্ছে, অর্থনীতি কতটা প্রয়োজনীয়। অর্থনীতিবিদরা এখন বলেন, এত গবেষণা করে কোনো লাভ হলো না। আবার নীতিনির্ধারকরা বলে থাকেন, আমরা যেসব তথ্য চাই, তা পাওয়া যাচ্ছে না। এই দ্বিধার অপসারণ করতে হবে। গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে কাজ করতে হবে।

ড. জায়েদী সাত্তার বলেন, নীতিনির্ধারকদের যেমন গবেষণা না করে নীতি নির্ধারণের প্রবণতা রয়েছে, তেমনি অবস্থা রয়েছে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মধ্যেও। বেসরকারি কোনো খাতের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে গবেষকদের ভীষণ কষ্ট করতে হয়। বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও নীতি নির্ধারণের জন্য প্রামাণ্য তথ্যনির্ভর গবেষণার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

সভায় বক্তারা আমাদের দেশের উপাত্ত ও তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা ও যথার্থতা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন। তারা বলেন, পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ বিভিন্ন সংস্থার তথ্যের মধ্যে গরমিল দেখা যায়। সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তাছাড়া নিয়মিত তথ্য না দিয়ে কয়েক বছর অন্তর অন্তর তথ্য পাওয়া যায়। প্রতিবছর ওই সব তথ্যের একটি ধারাবাহিকতা রক্ষা করা জরুরি। বক্তারা আরও বলেন, রাজনৈতিক চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নীতি নির্ধারণের ফলেই সাময়িক সমাধানের দিকে ঝুঁকে থাকে আমাদের নীতিনির্ধারকরা। সাধারণ কিছু পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হলো ঢাকা শহরে; কিন্তু তাতে যানজটের অবসান হলো না। এক্ষেত্রে কার্যকর সমাধান পেতে হলে প্রামাণ্য অভিজ্ঞতা ও গবেষণার বিকল্প নেই।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০