নীতি সিদ্ধান্তে রাজনীতিকদের ভূমিকা সংকুচিত হচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকারের নীতি সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা সংকোচিত হচ্ছে। সরকার জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা না করেই নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছে। পাশাপাশি নীতি সিদ্ধান্তে রাজনীতিবিদদের ভূমিকাও সংকুচিত করছে। পুরো প্রক্রিয়াটিই সম্পন্ন করছেন আমলারা। যেখানে রাজনৈতিক প্রভুদের কোনো স্থানই নেই।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এমন মন্তব্য করেছেন। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠান সিপিডি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) যৌথ আয়োজনে ‘ট্যাক্সিং দ্য ডিজিটাল ইকোনমি: ট্রেডি-অবস অ্যান্ড অপরচুনিটি’ শীর্ষক সংলাপে এসব কথা বলেন তিনি।

নীতি সিদ্ধান্তে রাজনীতিকদের অংশগ্রহণ না থাকার উদাহরণ দিতে গিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফের) থেকে ঋণ নেয়ার বিষয়টি সরকার অনুমোদন দিল। কিন্তু এ নিয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হলো না। এমনকি অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরকারি হিসাব-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কিংবা মন্ত্রিপরিষদ সম্পৃক্ত ছিল না। জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তারাই পুরো প্রক্রিয়ার অগ্রভাগে ছিলেন। কিন্তু তারা কি এ-সংক্রান্ত ফলাফলের দায়দায়িত্ব  নেবেন?

সংলাপে সিপিডির আরেক সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। সেমিনারে বক্তারা ডিজিটাল অর্থনীতির সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকার কারণে সরকার যে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে, সে বিষয়টি তুলে ধরেন। পাশাপাশি তারা তাগিদ দেন রাজস্ব বোর্ডের সক্ষমতা বাড়িয়ে কর আহরণ বাগানোর।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সরকার আইএমএফের ঋণ নেয়ার জন্য বেশ কিছু শর্ত মেনে নিয়েছে। তার মধ্যে অনত্যম হলো কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানো। প্রতি বছর জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর আদায়, কর ছাড় যৌক্তিক করা এবং কর আদায়ে প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। কিন্তু এসব বিষয় সরকারি কোনো আদেশের বলে রাতারাতি অর্জিত হয়ে যাবে না। এটা বিদ্যুতের দাম বা সারের দাম নয় যে আদেশ দিলাম, আর বেড়ে গেল। এর জন্য প্রয়োজন সক্ষমতা বৃদ্ধি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এসব শর্ত পূরণ করতে প্রতিষ্ঠানকে অনেক পরিশ্রম করতে হবে। তবে এই সংস্কার কার্যক্রমগুলো অনেক আগে করার কথা কিন্তু আমরা তা পারিনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘মাঝে মধ্যে বিদেশিরা এসে আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। আমরা আধা

খেচরাভাবে হয়তো সংস্কার করব, কিন্তু তা সুষ্ঠু হবে না। এর জন্য অংশীজনদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরিকল্পনা করা দরকার এবং এই পরিকল্পনাকে আগামী দিনে রাজনৈতিক উত্তরণের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। যারা নির্বাচনে যেতে চান, তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এ ধরনের সংস্কারের প্রতিফলন থাকতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া এবং নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত অংশীজন যারা দেশের উন্নয়নকে তুলে ধরেছেন, আগামী দিনে ধারণ করবেন, তাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে এই সংস্কার কার্যকর করা কষ্টকর হবে।’

মূল প্রবন্ধে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ হবে। আমাদের অর্থনীতির বড় অংশ ডিজিটাল ইকোনমি হবে। এ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ সম্পদের মাধ্যমে কীভাবে রাজস্ব বাড়াতে পারি, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। তিনি আরও বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে জিডিপির অনুপাতে কর আহরণ কম। আইএমএফও এটি তা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে। তবে এর জন্য এনবিআরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। করের ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে।

দেশে বহু আন্তর্জাতিক কোম্পানি কর দেয় না: দেশে বহু আন্তর্জাতিক কোম্পানি আছে যারা কর দেয় না বলে জানিয়েছেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, ডিজিটাল ইকোনমিক আমাদের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও কর অনুপাত বৃদ্ধির ক্ষেত্রে। আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক বড় বড় কোম্পানি, যাদের উপস্থিতি আছে কিন্তু রাজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে নেই। তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক কোম্পানির কর দেয় না বিষয়টি আমাদের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে যৌক্তিকভাবে ভোক্তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে তাদের করের আওতায় আনা যায় সেটাও দেখতে হবে। সেটার জন্য প্রতিষ্ঠান ও আইনগত প্রস্তুতি দরকার সেটাও নিতে হবে।

পদ্মা সেতুর টোল আদায় কেন বিদেশিদের হাতে: সেমিনারে উš§ুক্ত আলোচনায় এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, আমরা নিজের টাকায় পদ্মা সেতু করলাম কিন্তু টোল আদায়ের দায়িত্ব দিলাম বিদেশিদের। কেন? আমি খরচ অনেক উন্নয়ন করেছি, কিন্তু আয়ের উৎস কেন বাড়ছে না, সেই হিসাব মেলাতে হবে। ফেসবুক ও গুগলসহ সামাজিক মাধ্যমগুলোর বিষয়ে নীতিমালা দরকার। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অর্থনীতির সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিকভাবে সমস্যা তৈরি করছে। এর ফলে অনেক কথা বলা যাচ্ছে না। এমনকি লেখালেখির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট অনেকটা বিশেষ ক্ষমতা আইন হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের সংস্কার করা প্রয়োজন, ডিজিটাল কথাটা গুরুত্বপূর্ণ, এটা সাইবার সিকিউরিটি আইন হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, আগে আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত কেন কম হচ্ছে, কোথায় কোথায় লিকেজ সেটা খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের জিডিপি বাড়ছে, কিন্তু রাজস্ব আদায় কেন বাড়ছে না, সেটা জাতীয় সংসদেও আলোচনা হওয়া দরকার। লিকেজগুলো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আলোচনা হওয়া দরকার। সিপিডিও এ বিষয়ে গবেষণা করতে পারে।

সংলাপে প্রধান অতিথি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ বলেন, সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে কাজ করছে। স্মার্ট বাংলাদেশ হলে শতভাগ ডিজিটাইজড হবে। শতভাগ পেপারলেস কার্যক্রম হবে। রাজস্ব আদায় থেকে প্রশাসনিক কার্যক্রম পর্যন্ত সবকিছু অটোমেশন হবে। এর ফলে প্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থান যেমন বাড়বে, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে কাজে লাগিয়ে প্রশিক্ষিত জনশক্তি তৈরি হবে। রাজস্ব আদায়েও কাক্সিক্ষত ফল আসবে। গুগল, ফেসবুক, টুইটারের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে পুরোপুরি রাজস্বের আওতায় আনা না গেলেও আগামীতে আনা যাবে।

সেমিনারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দক্ষতার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিশেষ অতিথি ও জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য আহসান আদিলুর রহমান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) বলছে, গুগল, ফেসবুকের মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ থেকে বিলিয়নের বেশি টাকা নিয়ে গেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলছে ১৫৫ কোটি টাকা। এসব অর্থের জন্য তাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় জরুরি।

অনুষ্ঠানে এসব অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেনÑবাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) পরিচালক হাবিবুল্লাহ নেয়ামুল করিম, বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান তানজিবা রহমান, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সহসভাপতি মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন প্রমুখ।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০