নীরব ঘাতক উচ্চ রক্তচাপ

উচ্চ রক্তচাপের আরেক নাম হাইপারটেনশন বা এইচপিএন। এ রোগের কারণে ব্যক্তির রক্তের চাপ সব সময়েই স্বাভাবিকের চেয়ে ঊর্ধ্বে থাকে। হাইপারটেনশনকে প্রাথমিক (আবশ্যিক) হাইপারটেনশন অথবা গৌণ হাইপারটেনশনে শ্রেণীভুক্ত করা হয়। প্রায় ৯০-৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রাথমিক হাইপারটেনশন বলে চিহ্নিত করা হয়। বাকি ৫-১০ শতাংশ বিভিন্ন রোগের কারণে হয়।

হৃৎপিণ্ডের পাম্পিং ক্রিয়ার মাধ্যমে রক্তচাপ তৈরি হয়। রক্তচাপের কোনো একক নির্দিষ্ট মাত্রা নেই। বিভিন্ন বয়সের মানুষের শরীরে রক্তচাপের মাত্রা ভিন্ন এবং একই মানুষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে স্বাভাবিক রক্তচাপও বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। উত্তেজনা, দুশ্চিন্তা, অধিক পরিশ্রম ও ব্যায়ামের ফলে রক্তচাপ বাড়তে পারে। ঘুম ও বিশ্রাম রক্তচাপ কমিয়ে দেয়। রক্তচাপের এ পরিবর্তন স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যে পড়ে। অধিকাংশ সময় রক্তচাপের মাত্রা স্বাভাবিক মাত্রার ভেতরে থাকে। সাধারণত বয়স যত কম, রক্তচাপও তত কম। যদি কারও রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি হয় এবং অধিকাংশ সময় এমনকি বিশ্রামকালীনও বেশি থাকে, তবে ধরে নিতে হবে তিনি উচ্চ রক্তচাপের রোগী।

 

এটি কি আসলেই জটিল ব্যাধি

উচ্চ রক্তচাপ ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের কোনো প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যায় না। এটাই সবচেয়ে ভীতিকর দিক। যদিও অনেক সময় কোনো লক্ষণ থাকে না, তবু নীরবে উচ্চ রক্তচাপ শরীরের বিভিন্ন অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এজন্য একে ‘নীরব ঘাতক’ বলা যেতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত ও চিকিৎসাবিহীন উচ্চ রক্তচাপ থেকে মারাত্মক শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।

 

কারণ

৯০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কোনো নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না। একে প্রাইমারি বা অ্যাসেনসিয়াল রক্তচাপ বলে। সাধারণত বয়স্ক মানুষের উচ্চ রক্তচাপ বেশি হয়ে থাকে। কিছু বিষয় উচ্চ রক্তচাপের সম্ভাবনা বাড়ায়।

 

বংশানুক্রমিক

উচ্চ রক্তচাপের বংশগত ধারাবাহিকতা আছে। বাবা-মায়ের কারও উচ্চ রক্তচাপ থাকলে, সন্তানেরও হওয়ার শঙ্কা থাকে। এমনকি নিকটাত্মীয়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকলেও অন্যদের রক্তচাপের ঝুঁকি থাকে।

 

ধূমপান

ধূমপায়ীর দেহে তামাকের নানা ধরনের বিষাক্ত পদার্থের প্রতিক্রিয়ায় উচ্চ রক্তচাপসহ ধমনি, শিরার নানা রোগ ও হৃদ্রোগ দেখা দিতে পারে।

 

অতিরিক্ত লবণ খাওয়া খাবার লবণে সোডিয়াম থাকে, যা রক্তের জলীয় অংশ বাড়িয়ে দেয়। ফলে রক্তের আয়তন বেড়ে যায় এবং রক্তচাপও বেড়ে যায়।

স্থূলতা ও অলস জীবনযাপন

যথেষ্ট পরিমাণে ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম না করলে শরীরে ওজন বেড়ে যেতে পারে। এতে হৃদ্যন্ত্রকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়। ফলে অধিক ওজনসম্পন্ন লোকদের উচ্চ রক্তচাপ হয়ে থাকে।

 

অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস

অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার, যেমন মাংস, মাখন ও ডুবন্ত তেলে ভাজা খাবার ওজন বাড়ায়। ডিমের হলুদ অংশ ও কলিজা, গুর্দা, মগজ প্রভৃতি খেলে রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল হলে রক্তনালির দেয়াল মোটা ও শক্ত হয়ে যায়। ফলে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে।

অ্যালকোহল

অ্যালকোহলে অতিরিক্ত ক্যালরি থাকে। এতে ওজন যেমন বেড়ে যায়, তেমনি রক্তচাপও বাড়ে।

 

ডায়াবেটিস

বয়সের সঙ্গে ডায়াবেটিস রোগীদের উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়। এছাড়া তাদের অন্ধত্ব ও কিডনির নানা ধরনের রোগ হতে পারে।

 

উৎকণ্ঠা

অতিরিক্ত রাগ, উত্তেজনা, ভীতি ও মানসিক চাপের কারণেও রক্তচাপ সাময়িক বেড়ে যেতে পারে। যদি এ মানসিক চাপ অব্যাহত থাকে ও রোগী ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারেন, উচ্চ রক্তচাপ স্থায়ী রূপ নিতে পারে ।

এছাড়া কিছু রোগের কারণে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া গেলে একে বলা হয় সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন। এর কারণগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো কিডনিজনিত রোগ, অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি ও পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমার, ধমনির বংশগত রোগ, গর্ভধারণ অবস্থায় অ্যাকলাম্পসিয়া ও প্রি-অ্যাকলাম্পসিয়া, দীর্ঘদিন ধরে জন্ম নিয়ন্ত্রণের বড়ির ব্যবহার করলে, স্টেরয়েড-জাতীয় হরমোন গ্রহণ ও ব্যথা নিরামক কিছু ওষুধ খেলে।

 

জটিলতা

রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ চারটি অঙ্গে (হৃৎপিণ্ড, কিডনি, মস্তিষ্ক ও চোখ) মারাত্মক ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদ্যন্ত্রের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে যেতে পারে। দুর্বল হৃদ্যন্ত্র রক্ত পাম্প করতে পারে না। এ অবস্থাকে বলা হয় হার্ট ফেইলিওর। রক্তনালির গাত্র সংকুচিত হয়ে হার্ট অ্যাটাক বা ইনফার্কশন হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে ও স্ট্রোক হতে পারে, যা থেকে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। এছাড়া চোখের রেটিনায় রক্তক্ষরণ হয়ে অন্ধত্ব বরণ করতে পারে।

উচ্চ রক্তচাপ সারে না, একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এজন্য নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে। অনেক রোগী কিছুদিন ওষুধ খাওয়ার পর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এলে ওষুধ বন্ধ করে দেন। মনে করেন রক্তচাপ ভালো হয়ে গেছে, কাজেই ওষুধ খাওয়ার দরকার নেই। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কোনোক্রমেই ডাক্তারের নির্দেশ ছাড়া ওষুধ সেবন বন্ধ করা যাবে না।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০