রামিছা বিলকিছ জেরিন: বিশ্বের দেশে দেশে তামাক ব্যবহারকারী তথা ধূমপায়ীদের সংখ্যা খুব বেড়ে গেছে। ধূমপান আমাদের দেশে সর্বদাই কু-অভ্যাস বলে নিন্দিত হলেও এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়ে যাচ্ছে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে ধূমপান আমাদের শরীরের অনেক রোগের জননী। ধূমপানের কারণে যে শুধু ধূমপায়ীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা কিন্তু নয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এখান থেকে ওখানে ছোটাছুটি করতে হয়। সর্বস্তরে ধূমপায়ীরা নির্বিবাদে ধূমপান করেই যাচ্ছে। ট্রেনের কামরায়, বাসে কিংবা কোনো যাত্রীছাউনিতে ধূমপায়ীদের বিড়ি, সিগারেটের ধোঁয়া পরিবেশ দূষিত করেই যাচ্ছে। এক্ষেত্রে দেখা যায়, ধূমপান না করেও অধূমপায়ী শিশু বৃদ্ধ নারীসহ অনেকেই তামাকের তীব্র বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়।
নানান জাতের তামাক দিয়ে প্রস্তুত হয় এই বিড়ি সিগারেট জাতীয় দ্রব্যগুলো। এগুলোতে বিভিন্ন বিষক্রিয়া, সুগন্ধি মিশ্রিত থাকে। বিভিন্ন মাধ্যমে তামাক গ্রহণ করা যায়। যে যেভাবেই পান করুক না কেন এটা ক্ষতি করবেই। তামাকে থাকে নিকোটিন নামক উগ্র বিষ। ধূমপানের ফলে শরীরে নিকোটিন নামক বিষ প্রবেশ করে। প্রতি একটি সিগারেট পানের ফলে মানুষের জীবন থেকে ৫-৬ মিনিট আয়ু কমে যায়। ধূমপানের ফলে শরীরে নানারূপ ব্যাধি দেখা দেয়। তামাক গ্রহণের জন্য মানুষের চিন্তাশক্তি, বোধশক্তি কমে যায়।
মস্তিষ্ক অচল প্রায় হয়ে যায়। যার ফলে মানুষ সুচিন্তিত মতামত দিতে পারে না, যা দেয় তা হয় হঠকারী সিদ্ধান্ত।
বিভিন্ন মাধ্যমে তামাক গ্রহণ করা যায়। তবে যে যেভাবেই গ্রহণ করুক না কেন এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিবেই। প্রফেসর ডা. নূরুল ইসলাম বলেন, ধূমপানের ফলে আপাদমস্তক মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গে কুফল দেখা যায়। ধূমপানের ফলে অনেক বিচিত্র ধরনের রোগ হতে পারে। ধূমপানের ফলে ফুসফুসের ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। ধূমপানের বিষক্রিয়া প্রথমে ফুসফুস তারপর রক্তের সঙ্গে মিশে শরীরের নানা জায়গায় ছড়িয়ে যায়। ফলে দেখা যায় মৃত্যুদূত ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি হয়ে থাকে মানবশরীরে। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি করে এ ধূমপান।
তামাক ব্যবহারের ফলে দেশে প্রতি বছর এক লাখ ৬১ হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। পঙ্গুত্ববরণ করছে আরও কয়েক লাখ মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার ২০২১ সালের তথ্যমতে, সবচেয়ে কম দামে সিগারেট পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫টি দেশের মধ্যে ১০৭তম। ভারতে সবচেয়ে কম দামি সিগারেটের মূল্য বাংলাদেশের সবচেয়ে কম দামি সিগারেটের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। কার্যকর করারোপের অভাবেই দেশে সিগারেট সস্তাথেকে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ সালের প্রতিবেদনের বরাতে ওয়েবিনারে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে সিগারেটের অবৈধ বাণিজ্য ২৭টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম, মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ। সুতরাং সিগারেটের রাজস্ব ফাঁকি তথা অবৈধ বাণিজ্য নিয়ে যে প্রচারণা তা নীতিনির্ধারকদের বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা মাত্র। সিগারেট থেকে যে রাজস্ব আসে তার প্রায় পুরোটাই (৯৬ শতাংশ) ভোক্তারা প্রদান করে পরোক্ষ কর হিসেবে। কাজেই সিগারেট কোম্পানিগুলো সবচেয়ে বেশি কর দেয়, এটি মোটেও সত্য নয়। অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিড়িশিল্পে কর্মরত নিয়মিত-অনিয়মিত এবং চুক্তিভিত্তিক মিলিয়ে পূর্ণ সময় কাজ করার সমতুল্য শ্রমিক সংখ্যা মাত্র।
তামাক গ্রহণ বা ধূমপান যে শুধু স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে তা কিন্তু নয়। এটি দেশের সম্পদ ও নষ্ট করে। তামাক ব্যবহারে বছরে ক্ষতি হয় ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা বা ৩.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের জাতীয় আয়ের ১.৪ শতাংশ। ২০১৮ সালে তামাকজনিত রোগে প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষের অকালমৃত্যু হয়, যা দেশের মোট মৃত্যুর ১৩.৫ শতাংশ। এটা বৃদ্ধি পেয়ে এখন হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ। দিনকে দিন এটি বৃদ্ধি পেয়েই যাবে।
পৃথিবীতে একমাত্র বৈধ ব্যবসা তামাক, যে ব্যবসা মানুষকে সরাসরি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। দেশি-বিদেশি বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যে কারণে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তামাকের ব্যবহার ও তামাকজনিত মৃত্যু বাড়ছে। তামাকের ব্যবহার কমাতে উন্নত দেশগুলো জনগণকে তামাক সেবন থেকে দূরে রাখতে ছবিসহ সতর্কবাণী প্রদানসহ কঠোর তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করছে। বাংলাদেশেও কঠোর তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন এখন সময়ের দাবি। বিদ্যমান আইনের দুর্বলতা দূর করতে আইন সংশোধন প্রক্রিয়াধীন। কিন্তু মৃত্যুঘাতী তামাক কোম্পানিগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনকে বাধাগ্রস্ত করতে নানা ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। তামাকজনিত মৃত্যু কমাতে তামাক কোম্পানির ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে সব পর্যায়ের বেসরকারি সংগঠন, গণমাধ্যম, পেশাজীবী সংগঠনকে তামাকবিরোধী কাজে এগিয়ে আসতে হবে।
মাদক, তামাক, সিগারেট প্রভৃতি ক্ষতিকর দ্রব্য থেকে রক্ষা পেতে সবাইকে সচেতন হতে হবে। এগুলোর ক্ষতিকারক প্রতিক্রিয়া ব্যাপারে জনগণকে অবগত করতে হবে। বাজারের সব তামাকজাত পণ্য বিশেষ করে বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, গুল প্রভৃতির মোড়কে ‘তামাক মৃত্যুর কারণ’, ‘ধূমপান মৃত্যুর কারণ’ প্রভৃতি ‘সতর্কীকরণ বাণী’ মুদ্রিত থাকে। তবুও বৃদ্ধ থেকে শুরু করে তরুণেরা ধূমপান করে। তাদের সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বিষক্রিয়ার প্রভাবমুক্ত করতে হবে সবাইকে। তাদের শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক সব ধরনের ক্ষতি নিয়ে অবগত করতে হবে। ধূমপায়ীরা নিজেদের ক্ষতির পাশাপাশি আশপাশের সবার ক্ষতি করছে। এসব ধারণা দিতে হবে।
সবার কাছে সতর্কবার্তা পৌঁছে দেয়া সুনাগরিকের কর্তব্য। তাই সব বয়সী মানুষকে সচেতন হয়ে মাদকমুক্ত, তামাকমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকার
করতে হবে।
শিক্ষার্থী, ইসলামি শিক্ষা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়