নূর-উন-নবী ও সাফায়েত বিন নবী একই ব্যাংকে বাবা-ছেলে ঋণখেলাপি

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী মো. নূর-উন-নবী। প্রথমে বিভিন্ন পোশাক কারখানায় সুতাসহ বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহকারী হিসেবে তিনি সফল হন। পরে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের বলে ব্যাংক থেকে ঋণের টাকায় একাধিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এরপর কৌশলী হয়ে ব্যাংকঋণ পরিশোধে টালবাহানা শুরু করেন। ফলে ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকসহ পাঁচ ব্যাংকে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েন। নিজে খেলাপি হওয়ার পর অনভিজ্ঞ ছেলে সাফায়েত বিন নবীকেও একই পথে নিয়ে আসেন। সেও ব্যবসার নামে ঋণ নিয়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা খেলাপি।

বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পোশাক কারখানায় সুতা বেচাকেনা দিয়ে ব্যবসায়িক জীবন শুরু করেন নূর-উন-নবী। তিনি নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রামে এসে প্রথমে এ ব্যবসা শুরু করেন। ওই সময় বিভিন্ন গার্মেন্টে সুতা সরবরাহ করতেন। এরপর ব্যাংক থেকে ঋণসুবিধা পেতে একের পর এক গড়ে তোলেন নামসর্বস্ব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানÑআক্তার এন্টারপ্রাইজ, মেঘনা করপোরেশন, বলাকা হ্যাচারি, নূর-উন-নবী অ্যান্ড অ্যালাইড, নবী অ্যান্ড ব্রাদার্স, নবী অ্যান্ড কোং, আল নূর হজ্ব ও শাহজালাল ট্রেডার্স প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বলাকা গ্রুপ। এ গ্রুপের আক্তার এন্টারপ্রাইজ, নূর-উন-নবী অ্যান্ড অ্যালাইড ও শাহজালাল ট্রেডার্সের নামে ২০০৪-০৫ সালের দিকে কমার্স ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা থেকে ঋণসুবিধা নেন নূর-উন-নবী। মূলত কাপড় ও সুতা আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার জন্য ঋণ নেন। ঋণের টাকা পরিশোধ না করায় প্রতিষ্ঠানসহ নূর-উন-নবীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেছে ব্যাংকটি। বর্তমানে সুদাসলে হয়েছে প্রায় ১২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৯ সালে অর্থঋণ আদালতে ৭৪নং মামলার চলমান বিচারিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সম্পত্তি নিলামের আগে এ ঋণের বিপরীতে দক্ষিণ পতেঙ্গা ও দক্ষিণ কাট্টলি মৌজায় ২৭০ ডেসিমেল জমি বিচারের আগে অতিরিক্ত বন্ধকী হিসেবে নেয়ার জন্য আদালত রায় দেন। গতকাল চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান এ রায় দেন। এ খেলাপি নূর-উন-নবীর কাছে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাওনা রয়েছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রায় ১৩০ কোটি টাকা। অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি, সাউথ ইস্ট ব্যাংকের প্রায় ১৭ কোটি ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের প্রায় ১৬ কোটি টাকা। এসব পাওনা আদায়ে এখন আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে ব্যাংকগুলো। আবার বিভিন্ন ব্যাংক তাকে ঋণখেলাপি হওয়ার পর পুনঃতফসিলের সুযোগ দিলেও তিনি কোনো ডাউন পেমেন্ট দেননি। তারপর ব্যাংকগুলো মামলা করে। কিন্তু পর্যাপ্ত জামানত না থাকায় মামলা দায়েরের পরও ব্যাংকগুলোর ঋণের টাকা ফেরত পাওয়া অনিশ্চয়তায় আছে।

অপরদিকে বাবার মতো অখ্যাত ও অনভিজ্ঞ সাফায়েত বিন নবী ইস্পাত খাতের ব্যবসায় আসার জন্য ড্রিম স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠান গড়ার প্রাথমিক কাজ শুরু করেন। ড্রিম স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের নামে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করেন সাফায়েত বিন নবী। এ ব্যবসায় সহযোগী ছিলেন আলমগীর মুরাদ খান। এ ঋণ সুবিধার আওতায় গত ২০১৭ সালের জুলাই মাসে চীন থেকে বিভিন্ন ধরনের মেশিনারিজ ও মালামাল আনা হয়। এরপর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকার লতিফপুরের কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করেন। যদিও পুরোপুরি কারখানা স্থাপনের কাজ শেষ হওয়ার আগে ২০১৯ সালের শেষের দিকে ঋণটি খেলাপি হয়ে পড়ে। ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত ড্রিম স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের কাছে ব্যাংকটির সুদাসলে মোট খেলাপি পাওনার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৩৪ কোটি ৮৯ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩৫ টাকা। পাওনা আদায়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড হালিশহর শাখা ঋণের বিপরীতে বন্ধকীতে থাকা আমদানিকৃত প্রায় ৫৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকার মেশিনারিজ ও মালামাল নিলামে বিক্রির উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবে এ নিলাম কার্যক্রমে আগ্রহী কোনো উপস্থিতি ছিল না। পরে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অর্থঋণ আদালতে মামলা করে।

এদিকে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্ম অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালের যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্ম অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অফিস থেকে ড্রিম স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের নামে কোম্পানিটির নিবন্ধন নেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধন দেখানো হয় ২০ লাখ টাকা। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে সাফায়েত বিন নবী এবং চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন আলমগীর মুরাদ খান। আর প্রতিষ্ঠানটির নামে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড থেকে ২৭৬ কোটি টাকার ঋণ আছে বলে উল্লেখ করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৩ বা ২০১৪ সালের দিকে নূর-উন-নবীর ব্যবসা খারাপ হতে শুরু করে। কিন্তু নিজের প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিলেও এ অর্থ দিয়ে কৌশলে গড়ে তুলেছেন ছেলের প্রতিষ্ঠান ‘ড্রিম গ্রুপ’। ড্রিম গ্রুপ পরিচালনা করছেন নূর-উন-নবীর ছেলে সাফায়েত বিন নবী। কিন্তু বাবা-ছেলে কোনো ব্যাংকের টাকা পরিশোধে উদ্যোগ নিচ্ছে না।

এ বিষয়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, বলাকা গ্রুপের নূর নবী বিভিন্ন ব্যাংকে খেলাপি। অল্প সময়ে সুতা সবরাহকারী থেকে একাধিক প্রতিষ্ঠানের মালিক হন। কিন্তু পাওনা পরিশোধের মতো সক্ষমতা নেই। আবার ছেলের নামে স্টিল গড়ার প্রকল্প দেখিয়েও ব্যাংক থেকে আরও টাকা নেন। যদিও ড্রিম স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি, এর আগেই খেলাপি হয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে জানার জন্য খেলাপি ব্যবসায়ী নূর-উন-নবীর ব্যবহƒত ফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে সংযোগটি বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি। 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০