নিজস্ব প্রতিবেদক: নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংকে (এনবিবিএল) থাকা শেয়ার বিক্রির উদ্যোগ বন্ধ ও বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) স্থগিত করা নিয়ে নেপালের আদালতে রিট করেছিল বিনিয়োগকারী এলবি গ্রুপ। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের আইএফআইসি ব্যাংককে শোকজ (কারণ দর্শানোর নোটিস) করেছেন নেপালের উচ্চ আদালত। একইসঙ্গে নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকা আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ারের সম্ভাব্য ক্রেতাকেও কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে।
গত ২১ এপ্রিল এ শোকজ করা হয়। এতে দীর্ঘমেয়াদে ঝুলে যেতে পারে এনবিবিএলের শেয়ার হস্তান্তর। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে এমন তথ্য।
এদিকে কারণ দর্শানোর নোটিস প্রাপ্তির পর নেপালের ব্যবসায়ী এলবি শ্রেষ্ঠা লিখিত চিঠি দিয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক বরাবর। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, “এনবিবিএল’র অংশীদার হিসেবে আমি আইএফআইসির শেয়ার ক্রয়ের জন্য আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। ই-মেইল, চিঠি ও ফোনালাপের মাধ্যমে এ যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু আমাকে না দিয়ে অন্য কারও কাছে শেয়ার বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে নাবিল ব্যাংকের সঙ্গে একীভুত করার জন্য আইএফআইসি চুক্তিবদ্ধ হয়। অথচ আমিই প্রথম দাবিদার। আর উদ্যোক্তা হিসেবে এটিই আমার প্রাপ্য, যা কোম্পানি আইন অনুযায়ী উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডারই প্রথম দাবিদার যে কোনো শেয়ার বিক্রয়ের ক্ষেত্রে। এ বিষয়ে আমি নেপালের আদালতে মামলা করেছি। এজন্য শেয়ার বিক্রয়ের ওপর উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আমি আপনাকে এ-সংক্রান্ত তথ্যাদি সংযুক্ত করছি।”
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার হিসেবে এ শেয়ার আমার প্রাপ্য। কিন্তিু আমাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আদালতে বিবেচনাধীন থাকায় আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রয়ের জন্য ডাকা বিশেষ সাধারণ সভা স্থগিতের জন্য আপনাকে অবহিত করছি। আর নাবিল ব্যাংকের সঙ্গে প্রথমে একীভুত হয়ে শেয়ার বিক্রয় করলে আমাদের মতো উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার ও ব্যাংকের ক্ষতি হবে, যা কাম্য নয়।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিষয়টি আদালতে গড়িয়ে যাওয়ায় এখন শেয়ার বিক্রয় কার্যক্রমটি ঝুলে যাবে। এতে দীর্ঘমেয়াদি জটিলতায় পড়বে আইএফআইসি ব্যাংক।
প্রসঙ্গত, সর্বোচ্চ দরদাতাকে শেয়ার না দিয়ে সর্বনিন্ম দরদাতার কাছে বিক্রিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে আইএফআইসি। এতে আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রিতে সরকারের লোকসান হতে যাচ্ছে মিলিয়ন ডলার। এমন অভিযোগ করে নেপালের ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে চিঠিও দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর। এতে বলা হয়, নেপাল থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নিলে বাংলাদেশের মর্যাদা হানি হবে নেপালের সাধারণ মানুষের কাছে।
এর আগে শেয়ার বিক্রি বন্ধে নেপালের কাঠমান্ডু ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট (কেডিসি) আদেশ দিয়েছেন, চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান নাবিল গ্রুপ ও নেপালের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নেপাল রাষ্ট্র ব্যাংকের প্রতি।
জানা গেছে, নেপাল ও বাংলাদেশের আইএফআইসি ব্যাংকের যৌথ বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠা পায় ‘নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংক লিমিটেড (এনবিবিএল)’। এটি নেপালের জনগণের কাছে পরিচিতি পায় ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ নামে। ১৯৯৪ সালের ৬ জুন ব্যাংকটি বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। এনবিবিএল ইনভেস্টমেন্ট ও এনবিবিএল সিকিউরিটিজ নামে ব্যাংকটির দুটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানিও রয়েছে। এনবিবিএল নেপালের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত।
এদিকে সরকারি-বেসরকারি মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের আইএফআইসি। ব্যাংকটিতে রাষ্ট্রীয় মালিকানা শেয়ার রয়েছে ৩২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তথ্য অনুযায়ী, নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতি বছর মিলিয়ন ডলারের লভ্যাংশ পাচ্ছে আইএফআইসি ব্যাংক, যা রেমিট্যান্স হিসেবে আসছে দেশে। তারপরও ব্যাংকটি থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নিচ্ছে আইএফআইসি ব্যাংক।
আইএফআইসি ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দেবে। শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে নেপাল থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে আনবে আইএফআইসি ব্যাংক। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের জানাতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কাছে তথ্যও দেয় আইএফআইসি। মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হিসেবে তা প্রকাশ করে ডিএসই। অন্যদিকে নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংকও সে দেশে তালিকাভুক্ত। এজন্য আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রির তথ্য নেপাল স্টক এক্সচেঞ্জেও প্রকাশ করা হয়।
শেয়ার বিক্রির তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পরই নেপালের শিল্পগ্রুপ এমভি দুগার গ্রুপের চেয়ারম্যান মতিলাল দুগার আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার ক্রয়ে যোগাযোগ শুরু করেন। এর সঙ্গে আরেক দাবিদার হচ্ছেন এলবি শ্রেষ্ঠার মালিকানাধীন এলবি গ্রুপ। কিন্তু শেষ পর্যায়ে মতিলাল দুগার বা এলবি গ্রুপকে শেয়ার না দিয়ে বিক্রি করা হয় নাবিল গ্রুপের কাছে। প্রতি শেয়ার বিক্রিতে মতিলালের প্রস্তাব ছিল ১৬০ নেপালি রুপি। আর এলবি গ্রুপ এ শেয়ার কিনতে চেয়েছিল ১৬১ রুপিতে। কিন্তু নাবিল গ্রুপের কাছে শেয়ার বিক্রিতে চুক্তি করা হয় প্রতিটি ১৫৭ রুপি।
এদিকে শেয়ার বিক্রির ঘোষণার পরপরই শঙ্কর গ্রুপ প্রস্তাব করে যে কোনো মূল্যে (আইএফআইসি ব্যাংকের চাওয়া মূল্যে) সব শেয়ার কিনবে। কিন্তু সেই প্রস্তাবেও রাজি হয়নি আইএফআইসি ব্যাংক। উপায় না পেয়ে গত ১১ জানুয়ারি নেপালের আদালতে রিট করে মতিলাল দুগার। এতে শেয়ার বিক্রয় প্রক্রিয়ার ওপর স্থগিতাদেশ দেয়া হয়। কিন্তু আদালতের দেয়া রায় উপেক্ষা করে গত ১৩ জানুয়ারি চৌধুরী গ্রুপের মালিকানাধীন নাবিল ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংক। নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকা আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করতে এ চুক্তি করা হয়। আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রির পর নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংক দেশটির নাবিল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে।
বর্তমানে নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংকের মোট শেয়ারের মধ্যে ৪০ দশমিক ৯০ শতাংশ হচ্ছে আইএফআইসির, যার পরিমাণ হচ্ছে তিন কোটি ৬৮ লাখ ২৭ হাজার ৪২৬টি। সর্বশেষ হিসাববছরের জন্য ব্যাংকটি বিনিয়োগকারীদের ১২ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। নতুন পাওয়া বোনাস শেয়ার মিলিয়ে আইএফআইসির মোট শেয়ারের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে চার কোটি ১২ লাখ ৪৬ হাজার ৭১৭টি।
এ বিষয়ে সানরাইজ ব্যাংকের চেয়ারম্যান মতিলাল দুগার এর আগে জানিয়েছিলেন, ‘আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার হস্তান্তরে তার সঙ্গে (মতিলাল দুগার) চুক্তি হয়েছে। মতিলাল এই শেয়ার কিনে নেবেন। কিন্তু সম্পাদিত চুক্তির শর্ত ভেঙে নাবিল গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করেছে আইএফআইসি ব্যাংক। এজন্য পুরো প্রক্রিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। ফলে আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রয়ের বিষয়টি এখন আদালতের অধীনে চলে গেল। আইনি লড়াই শেষে জানা যাবে শেয়ার বিক্রয়ের পরিণতি কী হয়।’
এদিকে উচ্চ দামের পরও কেন কম দামে শেয়ার বিক্রয়ে আইএফআইসি চুক্তিবদ্ধ হলো, তা নিয়ে চলছে নানামুখী গুঞ্জন। অভিযোগ উঠেছে, নেপাল ও বাংলাদেশের একটি সংঘবদ্ধ চক্র এ বিক্রয় প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে শেয়ার বিক্রির প্রক্রিয়া চলছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে নেপালের আর্থিক গোয়েন্দা দপ্তরেও অভিযোগ দায়ের হয়েছে।
নেপালের ব্যবসায়ীরা মনে করেন, সঠিক তদন্ত হলে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের নাম বেরিয়ে আসবে। এরই মধ্যে আইএফআইসি ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের দুই কর্মকর্তা ও এক পরিচালকের সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে এসেছে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে।
দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ায় সম্প্রতি শেয়ার বিক্রির বিষয়টি মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হিসেবে বিনিয়োগকারীদের জানানো হয়। কিন্তু সেখানে শেয়ারের বাজার মূল্য বা কবে নাগাদ শেয়ার হস্তান্তর করা হবেÑএমন তথ্য দেয়া হয়নি। শুধু জানানো হয়, ‘নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকা আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করা হবে। এজন্য একজন সম্ভাব্য ক্রেতার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম সরওয়ারের সঙ্গে একাধিকবার মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার কাছ থেকে কোনো মন্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।