নৈতিকতার অবক্ষয় রোধে সামাজিক মূল্যবোধ

মো. জিল্লুর রহমান: সাম্প্রতিক তিনটি ঘটনা আমাদের দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে। প্রথমত, নড়াইলে একজন কলেজ অধ্যক্ষকে তারই সহকর্মীরা জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করেছে। দ্বিতীয়ত, সাভারের একটি স্কুলের এক শিক্ষার্থী তারই শিক্ষককে স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে মারাত্মক আহত করে এবং ওই শিক্ষক পরবর্তী সময়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এবং তৃতীয়ত রাজশাহীতে একজন আইন প্রণেতার বিরুদ্ধে এক কলেজ অধ্যক্ষকে পিটিয়ে গুরুতর জখম করার অভিযোগ উঠেছে। তিনটি ঘটনাই দেশ ও জাতির জন্য বেশ লজ্জাজনক, অনাকাক্সিক্ষত এবং অগ্রহণযোগ্য। এগুলো নৈতিক অবক্ষয়ের নিকৃষ্টতর দৃষ্টান্ত। ঘটনাগুলো জাতির বিবেককে যেমন চরমভাবে নাড়া দিয়েছে, তেমনিভাবে সবাইকে অবাক ও বিস্মিত করেছে।

আসলে একাডেমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পড়ালেখা করে শিক্ষিত হওয়া যায়, মেধাবী হলে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে দেশের সীমানা পেরিয়ে ভিনদেশেও নাম কুড়ানো যায়, কর্মক্ষেত্রে বহু বেতনে উচ্চপদে সমাসীন হওয়া যায় কিন্তু নৈতিক মূল্যবোধ ও সুশিক্ষা না থাকলে একসময় সব কিছুই ম্লান হয়ে যায়। প্রত্যেক মানুষের সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন তা হলো নৈতিক মূল্যবোধ। আর নৈতিক মূল্যবোধ শুরু হয় পরিবার থেকে এবং নৈতিক শিক্ষা এর মূল ভিত্তি। কারণ সভ্যতা, ভদ্রতা, নৈতিকতা, কৃতজ্ঞতা বোধ, অপরের প্রতি শ্রদ্ধা-স্নেহ, পরোপকার, উদার মানসিকতা এগুলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে খুব বেশি অর্জন করা যায় না। এগুলোর ভিত্তি প্রোথিত হয় সামাজিক মূল্যবোধ লালনপালন ও সুশিক্ষার মাধ্যমে।

মানসিক বিকাশ ও নৈতিক চরিত্র গঠনে সামাজিক মূল্যবোধ ও পারিবারিক সুশিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। মূলত মায়ের কোলে শিশুর শিক্ষার হাতেখড়ি। পরিবার থেকেই শিশু প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। ফলে পরিবার মানব সন্তানের প্রথম শিক্ষা নিকেতন। সন্তানের মূল্যবোধ, চরিত্র, চেতনা ও বিশ্বাস জন্ম নেয় পরিবার থেকেই। বাবা-মা যেমন আদর্শ লালন করেন, তাদের সন্তানরাও সেটা ধারণ ও লালন করার চেষ্টা করে। পরিবার হলো প্রেম-প্রীতি ভালোবাসা ও মায়া-মমতায় ভরা এমন একটি সুসজ্জিত বাগানের মতো যেখানে প্রতিটি সদস্য তার চারিত্রিক গুণাবলি বিকশিত করার পর্যাপ্ত সুযোগ পায়। নৈতিক গুণাবলিসমৃদ্ধ হয়ে তারা পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে সুশোভিত ও মোহিত করে। এটা এমন এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল যা বাইরের যাবতীয় পঙ্কিলতা ও আক্রমণ থেকে শিশুসন্তানকে সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম। 

শিশুর সামাজিক মূল্যবোধ শিক্ষার প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র হলো পরিবার। আর পরিবার থেকেই মূল্যবোধ শিখালে সন্তানের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে প্রগতিশীল, দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ করে তোলে। সামাজিক, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে মূল্যবোধ শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যক্তির আচার-আচরণ তথা তার চরিত্র গঠনে তার নিজস্ব সমাজের মূল্যবোধ যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। ব্যক্তি বিভিন্ন পরিবেশে কীভাবে মিশবে, স্থান-কাল পাত্রভেদ অনুযায়ী কীভাবে আচরণ করবে, কাকে স্নেহ আর কাকে শ্রদ্ধা করবে, কাকে কীভাবে সমীহ করবে, কোন বিষয় কতটা ভক্তিভরে বা গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করতে পারবে, তার অনেকটাই তার সমাজ থেকে অর্জিত আদর্শ ও মূল্যবোধের ওপর নির্ভর করে। পরিণত বয়সে ব্যক্তি তার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে কী ভূমিকা রাখবে সেটাও অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারিত হয় বাল্য ও কৈশোরে সমাজ থেকে অর্জিত মূল্যবোধ দ্বারা। সবক্ষেত্রেই সামাজিক মূল্যবোধের পাওয়া ও অর্জিত শিক্ষা ব্যক্তির আচরণকে মার্জিত করে তুলে। তবে এই শিক্ষা অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত। মূল্যবোধ শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, ব্যক্তিকে তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে প্রগতিশীল, দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ করে তোলা। সামাজিক মূল্যবোধের প্রধানতম উৎস এবং শিক্ষার নির্ধারকগুলো হলো প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি, প্রথা, বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা, ইতিহাস, ঐতিহ্য  প্রভৃতি।

সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে সর্বজনস্বীকৃত যেসব ভালো, উত্তম, সুন্দর, চমৎকার, শালীন, সৌহার্দ্যপূর্ণ ও কল্যাণকর বিষয়, যা কোনো সমাজকে কল্যাণময় সোনালি সমাজে পরিণত করে, সেগুলোর চর্চা ও সংরক্ষণের সক্রিয় চেতনাবোধ। সামাজিক মূল্যবোধই মূলত যেকোনো সমাজের অলঙ্কার ও মণিমুক্তা। পক্ষান্তরে, নৈতিক অবক্ষয়? শব্দের আভিধানিক অর্থ চরিত্রের ক্ষয়প্রাপ্তি। নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধের চর্চা না থাকা, কিংবা সামাজিক মূল্যবোধের ধ্বংস নামা, কিংবা বিলুপ্তি ঘটা। আর এই অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব, অসহিষ্ণুতা ও সর্বগ্রাসী অশ্লীলতার মতো আরও কিছু বিষয়।

আজকের তরুণরাই জাতির আগামী দিনের কর্ণধার। তাদের বেড়ে ওঠা ও প্রাপ্ত শিক্ষার ওপর সংশিষ্ট রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা নির্ভর করে। তাই তরুণ প্রজš§ এবং তার ভবিষ্যৎ ও নীতি-নৈতিকতা নিয়ে বর্তমান প্রজš§কেই ভাবতে হয়। চলমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে তরুণ প্রজš§ নিজে নিজে বেড়ে উঠবে এমন ভাবাটা ঠিক নয়। সুষ্ঠু ও সুপরিকল্পিত পরিকল্পনার মাধ্যমে তাদের গড়ে তুলতে হয়। প্রয়োজন হয় যতœ ও পরিচর্যার। বিগত কয়েক দশক ধরে সেই যত্ন ও পরিচর্যার অভাবেই সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক অবক্ষয়, নতুন প্রজন্ম ধাবিত হচ্ছে অধঃপতনের দিকে। তাই আমরা যদি এখন থেকেই সচেতন না হই, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না গ্রহণ করি, তাহলে তরুণ প্রজন্মের ধ্বংস অনিবার্য, যা সমগ্র জাতির জন্য এক মহা সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে একে অপরের মাঝে পারস্পরিক  শ্রদ্ধাবোধের অভাব প্রকট। পরমত সহিষ্ণুতা ও ধৈর্য সামাজিক মূল্যবোধের অন্যতম চাবিকাঠি। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তা লক্ষ করা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। ছোট ছোট অনু পরিবারগুলোতে ঈর্ষা ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব এসে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটি দখল করে নিয়েছে, পারিবারিক আবহকে করে তুলেছে বিষাক্ত। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সন্তানেরা। অসুস্থ পারিবারিক আবহে সন্তানও অস্বাভাবিক মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। সেই সাথে সামাজিক বিশৃঙ্খলা, সুশাসনের অভাব, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, পেশীশক্তির প্রভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, সর্বোপরি লাগামহীন অশ্লীলতাই আজকের তরুণ সমাজকে চরম অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

বহির্বিশ্বে উন্নত দেশগুলোতে শুধু সমাজে নয় তারা সর্বক্ষেত্রে তাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা করে। তাই উন্নত দেশগুলোতে একটা জিনিস লক্ষ্য করলে দেখা যায়, কোনো ব্যক্তি যদি তার সন্তানদের নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে বের হন তাহলে তাদের মূল্যবোধ কত সুন্দর। সেই সন্তান যদি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে একটা কলা খায় তাহলে সেই সন্তানকে কলার খোসাটা নির্দিষ্ট একটা ডাস্টবিনে ফেলতে বলবে, না হয় সেই খোসাটা কোনো পলিথিন বা অন্য কিছুতে মুড়ে বাসার ডাস্টবিনে ফেলার নির্দেশ দেন। এটা হলো তাদের সমাজ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, যেখানে ছোট থেকেই নৈতিকতা শিক্ষা লাভ করে। পরিবার তার সন্তানকে ছোট থেকেই যদি ন্যায়, সৎ এবং আদর্শবান করে না তোলে, তাহলে সে সমাজের জন্য যে মূল্যবোধ লালন ও ধারণ করে, সেই মূল্যবোধটি জাগ্রত করতে পারবে না। প্রকৃত কথা হচ্ছে, সামাজিক অবক্ষয় রোধ করার জন্য একজন সন্তানকে প্রথম থেকে মূল্যবোধ শিক্ষা প্রদান করা পরিবারের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য।

বর্তমান সময়টি ফেসবুক, ইন্টারনেটের। এ যুগে নিজেদের চরিত্র ঠিক রাখা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপারই বটে। বর্তমানে পরিবার ও সমাজের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে চরিত্রহীনতার দিকটি বিশেষভাবে ফুটে ওঠে। ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং, ধর্ষণ, মাদকের ছোবল প্রভৃতি সমাজকে কলুষিত করে তুলেছে। অনেকে বলছেন, পিতা-মাতার সঠিক তত্ত্বাবধান, নৈতিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় অনুশাসন তথা সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে, যা একদিকে যেমন অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক ঘটনা, ঠিক তেমনিভাবে কোনো ক্রমেই কাম্য ও গ্রহণযোগ্য নয়। মা-বাবা, ভাইবোন, পাড়া-প্রতিবেশীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ চরিত্রের প্রয়োজনে পারিবারিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় অনুশাসনকে একেবারে গুরুত্বহীন মনে করেন। পারিবারিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় অনুশাসন পরিপালনে পিতা-মাতার ভূমিকা ব্যাপক। পরিবার ও সমাজের যুবকদের চরিত্র গঠনের জন্য বাবা-মা, কর্তাব্যক্তিদের এগিয়ে আসা দরকার। কেবল মাদক ও সন্ত্রাস নির্মূলের ক্ষেত্রে নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে সামাজিক মূল্যবোধের গুরুত্ব অপরিসীম।

এই সর্বগ্রাসী সামাজিক অবক্ষয় থেকে বাঁচতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করা। সেই সঙ্গে প্রয়োজন পরমত সহিষ্ণুতার চর্চা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করা। এছাড়া সকল প্রকার অশ্লীলতা শুধু বর্জনই নয়, ক্ষেত্রবিশেষে এর প্রতিরোধও করতে হবে। যার শুরুটা হতে হবে নিজ গৃহ থেকে। সামাজিক সমস্যা দূর করতে রাষ্ট্রের সহযোগিতার হয়তো প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু মূল দায়িত্ব সমাজ তথা পরিবারকেই নিতে হবে। সন্তানকে আরও বেশি সময় দিতে হবে, তাদের মানসিকতা বোঝার চেষ্টা করতে হবে, সর্বোপরি তার নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

ব্যাংক কর্মকর্তা ও মুক্ত লেখক

zrbbbp@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০