Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 1:03 am

নোয়াখালীতে এখন বাবুইয়ের দেখা মেলে কদাচিৎ

নোয়াখালী সদর উপজেলার ধর্মপুর হাফেজিয়া জামে মসজিদের পাশের একটি গাছে সেদিন চোখে পড়ল শৈল্পিক কারিগর-খ্যাত বাবুই পাখির একাধিক বাসা। এ দৃশ্য নজর কাড়ে যে কোনো পথচারীর। স্থানীয় পাখিপ্রেমী সোনাপুরের জহির মিয়া বলেন, পাখিটি আসলে প্রাকৃতিক দর্জি। এর বুননে সত্যিকারের জাদু আছে। এ পাখি শিল্পের নিদর্শনও বটে। একে দেখে আমাদেরও শেখার আছে অনেক কিছু। পরিবেশ ও মানবতাবাদী কর্মী দ্বীপ আজাদ বলেন, একটা সময় ছিল যখন গ্রামাঞ্চলে বাবুই পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যেত।
বর্তমানে এসব আলাপচারিতা যেন বইয়ের ছড়া আর দাদুর কাছে শোনা গল্পের মতো মনে হয়। এখন গ্রামগুলোয়ও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। সেইসঙ্গে জলাশয়সহ কৃষিজমিতে বালু ফেলে ভরাট করে, গাছপালা কেটে বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। তাই এখন আর আগের মতো গ্রামাঞ্চলের রাস্তার ধারে, বাড়ির আশপাশ ও পুকুরপাড়ে গাছের সংখ্যা কমে এসেছে, দেখা মেলে না শৈল্পিক বাবুই পাখিরও। তাই বাবুই পাখি ও এর শৈল্পিক নিদর্শন রক্ষার জন্যে দ্রুত সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন অনেকে।
‘বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়–ই, কুঁড়েঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই। আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে,’ কবি রজনী কান্ত সেনের এই অমর কবিতাটি এখন তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে পাঠ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। পাঠ্যপুস্তকের কবিতা পড়েই এখনকার শিক্ষার্থীরা বাবুই পাখির শৈল্পিক নৈপুণ্যের কথা জানতে পারছে। কেননা এখন আর চোখে পড়ে না বাবুই পাখি ও তার নিজের তৈরি দৃষ্টিনন্দন সেই ছোট্ট বাসা তৈরির নৈসর্গিক দৃশ্য।
‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতাটি আজও মানুষ উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করলেও হারিয়ে যেতে বসেছে বাবুই পাখি ও তার বাসা। এদের বাসা আজ অনেকটা স্মৃতির অন্তরালে বিলীন হতে চলেছে। অথচ আজ থেকে প্রায় ১৫ বছর আগেও গ্রামগঞ্জের মাঠঘাটের তালগাছে দেখা যেত এদের বাসা। এসব বাসা শুধু শৈল্পিক নিদর্শনই ছিল না, মানুষের মনে চিন্তার খোরাক জোগাত ও স্বাবলম্বী হতে উৎসাহ দিত। বিশ্লেষকরা মনে করেন, বর্তমানে বাবুই পাখি বাসা বাঁধতে পারে যে গাছগুলোয় সেগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে তৈরি হচ্ছে ইট-কংক্রিটের ইমারত। অতীতের মতো তাল, নারকেল ও সুপারি গাছ না থাকায় হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখি।
বাবুই আবহমান বাংলার শোভন পাখি। তালগাছের পাতায় ও নারিকেল গাছের পাতায় একান্নবর্তী পরিবারের মতো দলবেঁধে দোল খেত পাখিগুলো। তালগাছে এদের বাসা নিসর্গকে মনোরম করে তুলতো। যেমন দৃষ্টিনন্দন তাদের বাসা, ঠিক তেমনি মজবুত। প্রবল ঝড়-বৃষ্টি-বাতাসেও টিকে থাকে তাদের একটি একটি করে লতাপাতা দিয়ে তিলে-তিলে গড়া বাসাগুলো। খড়ের ফালি, ধানের পাতা, তালের কচিপাতা এবং ঝাউ ও কাঁশবনের লতাপাতা দিয়ে উঁচু তালগাছে বাবুই দেখা যেত। এরা চমৎকার আকৃতির বাসা তৈরি করত এসব স্থলে।
সাংবাদিক মুলতানুর রহমান মান্না বলেন, বাবুই পাখি একাধারে শিল্পী, স্থপতি ও সামাজিক বন্ধনেরও প্রতিচ্ছবি। শক্ত বুননের এ বাসা ছেঁড়া কঠিন। শঙ্কার বিষয়, হারিয়ে যাচ্ছে মিষ্টি-মধুর কণ্ঠে বাবুই পাখির গান।
কথিত আছে, বাবুই পাখি রাতের বেলায় ঘর আলোকিত করার জন্যে জোনাকি পোকা ধরে নিয়ে বাসায় রাখে। সকাল হলে আবার তাদের ছেড়ে দেয়। বাবুই পাখি বাসা তৈরির পর সঙ্গী খুঁজতে যায় অন্য বাসায়। সঙ্গী পছন্দ হলে স্ত্রী বাবুইকে সঙ্গী বানানোর জন্য নানাভাবে ভালোবাসা নিবেদন করে এরা। বাসা তৈরির কাজ অর্ধেক হলে স্ত্রী বাবুইকে সে বাসা দেখায়। বাসা পছন্দ হলে কেবল সম্পর্ক গড়ে। স্ত্রী বাবুই বাসা পছন্দ করলে বাকি কাজ শেষ করতে পুরুষ বাবুইয়ের সময় লাগে চার দিন। স্ত্রীর প্রেরণায় পুরুষ বাবুই মনের আনন্দে শিল্পসম্মত ও নিপুণভাবে বিরামহীন কাজ করে বাসা তৈরির জন্য।
প্রেমিক বাবুই যত প্রেমই দেখাক না কেন, প্রেমিকা ডিম দেওয়ার পরে প্রেমিক বাবুই আবার খুঁজতে থাকে অন্য সঙ্গী। পুরুষ বাবুই এক মৌসুমে ছয়টি বাসা তৈরি করতে পারে। ক্ষেতের ধান পাকার সময় হলো বাবুই পাখির প্রজনন মৌসুম। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার পরপরই বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য স্ত্রী বাবুই ক্ষেত থেকে দুধ-ধান সংগ্রহ করে।
রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হলে হয়তো এসব পাখি টিকিয়ে রাখা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাহলে আবারও গাছে গাছে দলবেঁধে বাসা তৈরি করে বসবাস করবে বাবুই, জুড়াবে প্রকৃতিপ্রেমীদের চোখের তৃষ্ণা। বাবুইয়ের কিচিরমিচির শব্দে ভরে উঠবে সকাল-সন্ধ্যা আকাশ-বাতাস। রক্ষা পাবে পরিবেশ-প্রতিবেশ।

আকাশ মো. জসিম