রিপন চন্দ্র পাল: আমাদের দেশ জালের মতো নদ-নদীতে পরিবেষ্টিত। ওই জলপথে পণ্য আনা-নেয়া থেকে শুরু করে যাত্রী যাতায়াতও হয়- সেই প্রাচীনকাল থেকেই। এরকম নৌপথ দেশে কয়েক হাজার আছে। তবে বিষয়টা এখানেই শেষ নয়। বরং প্রতি বছর এসব পথে নৌ-চলাচল করতে গিয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় যাত্রীদের। অঝোরে এই পথে প্রাণ ঝরছেই। গেল বছর ২০২১-এও এ দুর্ঘটনার অন্ত নেই। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা থেকে বরগুনা যাওয়ার পথে দিবাগত মধ্যরাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে বিভীষিকাময় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। প্রাণ হারান এ পর্যন্ত ৪৭ জন।
সময় বদলেছে, যুগ পরিবর্তন হয়েছে। এখন সব দিকে পাকা রাস্তা-ঘাট। গাড়ি মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছায়। তবুও যাতায়াতের সুবিধার্থে বিশেষ করে দক্ষিণ বাংলার জনতা নৌপথকে অধিক নিরাপদ, উপভোগ্য মনে করে। এমভি অভিযান-১০ লঞ্চের দুর্ঘটনা ছাড়াই বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) তথ্যানুযায়ী, ৪২ বছরে নৌ-দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৭৩৩ জন মারা গেছেন এবং ওই সময়ে ৬৪১টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ২০১৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিআইডব্লিউটিএর কাছ থেকে আর কোনো নৌ-দুর্ঘটনার তথ্য পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান যাত্রী কল্যাণ সমিতির দেয়া তথ্যমতে, ২০২১ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৬০১টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৭৭৩ জনের প্রাণনাশ হয়। এই পর্যন্ত পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে প্রশ্ন উঠে, যাত্রীদের জন্য নৌপথ আদৌ কতটা নিরাপদ? এসব ঘটনার ফলে রাষ্ট্র যেমন জনশক্তি হারিয়েছে, তেমনি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে হাজারো পরিবার। অনেক পরিবার তাদের কর্মক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়েছে, পথে বসেছে ওই পরিবার। প্রতিবার এমন দুর্ঘটনার পরপরই পত্র-পত্রিকায়, টিভিতে কিছুদিন হƒদয়বিদারক সংবাদে চারদিক মুখরিত হয়ে যায়। সেসবের পরে নিয়ম মোতাবেক বেশক’টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। চলে তদন্ত, পরে কোর্ট। এরপরে আবারও কোনো বড় সংবাদ এসে চাপা পড়ে পূর্বের নৌ-দুর্ঘটনার কথা। মানুষও সম্ভবত সেসব ভুলে যায়। আবারও একইভাবে তারা লঞ্চে যাত্রা করেন। কিন্তু যারা স্বজন হারিয়েছেন তারা পান না বিচার। এমনকি নৌ-দুর্ঘটনার জন্য কঠোর সাজারও নেই কোনো জ্বলন্ত উদাহরণ। ফলে এসব দুর্ঘটনা থেমে থাকে না।
প্রকাশিত খবর বা নানা মহলের প্রতিবাদের ভিত্তিতে মুখরোচক তদন্ত কমিটি গঠন হয় ঠিকই কিন্তু বিশাল জনতার কান পর্যন্ত সেসবের ফলাফল যেতে ব্যর্থ হয়। হারানো স্বজনের বিচার প্রত্যাশীরা পান না কোনো সুবিচার আবার তথাকথিত অভিজাত ধাঁচের নৌ-ব্যবসায়ীরা ছাড়া পেয়ে আনন্দে মেতে ওঠে। বিপরীত দিকে, স্বজন হারানো করুণরা সরাসরি নৌ-আদালতে মামলা করতে পারেন না, মামলা করতে গেলে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কিংবা সংশ্লিষ্ট থানার ওসির মাধ্যমে মামলা করতে হয়। তাছাড়া অভিজাত বা তথাকথিত ধনাঢ্য ব্যক্তি হওয়ায় সেই মামলার প্রভাবও নিত্যান্ত অল্প বিরাজ করে। সেই সঙ্গে আইনের ফাঁকফোকর তো আছেই। তাই অচিরেই অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ-১৯৭৬ (আইএসও-১৯৭৬) আইনটির পরিবর্তন বা সংশোধন হওয়া সময়ের দাবি মাত্র।
বিষয়টা অধিক গুরুত্বের সহিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যদি সরকার কার্যত হস্তক্ষেপ করে তাহলে এই সমস্যার সমাধান সহজেই করা সম্ভব। আবার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে পুরো নৌ-খাতটা পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা দরকার; যাতে করে ধীরে ধীরে দুর্নীতির পরিমাণটা যেন কমে আসে। সেই সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সঙ্গোপনে নজরদারিও করা উচিত। দ্বিতীয়ত, বিআইডব্লিউটিএর ঢাকা নদী বন্দরের তথ্যানুযায়ী, সদরঘাটের মোট ৩২টি কাউন্টার রয়েছে। কিন্তু এসব অব্যবহƒত। আবার লঞ্চের কেবিনের টিকিট পেতে গেলে দালালদের ধরনা দিতে হয়, সেসব রোধের জন্য নৌ-মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অচিরেই সেসব কাউন্টার খুলে টিকিট বিক্রি এবং অর্ধশতাংশ টিকিট অনলাইনে বিক্রি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ফলে টিকিটবিহীন ও অতিরিক্ত যাত্রী ওঠার পরিমাণটা যেমন হ্রাস পাবে, তেমনি গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ীর দ্বারা পরিচালিত রোটেশন প্রথা বিলুপ্ত করে ঢালাওভাবে নৌ-ব্যবসাটাকে সাজিয়ে আধুনিকায়ন করতে হবে এবং পুরোনো ব্যবসায়ীর সঙ্গে সঙ্গে নবীন ব্যবসায়ীরাও যেন এই ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে আগ্রহ পান, সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। তৃতীয়ত, লঞ্চে যাতে জীবন বাঁচানোর জন্য পর্যাপ্ত প্রাণরক্ষা সামগ্রী বাধ্যতামূলক রাখা থাকে, সেটা প্রতিনিয়ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরিদর্শন করে সেরকম ব্যবস্থা নেয়া। চতুর্থত, নির্দিষ্ট কিছুদিন পর অভিজ্ঞ জনশক্তির দ্বারা নৌযানের যন্ত্রাংশ যথাযথ আছে কিনা, তা পরিদর্শন করা এবং নৌযানের ফিটনেস সনদ, পরিচালকের সনদ দেয়ার সময় যথাযথ কর্তৃপক্ষ যাতে অধিক সচেতনতা অবলম্বন করে সেসব লক্ষ্য রাখা। আবার নির্দিষ্ট দিন অন্তর অন্তর নৌযান সংশ্লিষ্টদের নানা রকম কর্মশালার মাধ্যমে তাদের দক্ষতা উন্নয়নে যেমন কাজ করতে হবে, তেমনি অতিরিক্ত যাত্রী লঞ্চে উঠলে সম্ভাব্য বিপদ কী দাঁড়াতে পারে, সেটা জ্ঞাত করে সর্বস্থরের জনগণের মধ্যে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচারণা চালাতে হবে। শেষতক, যাত্রী যাতে পূর্ণাঙ্গ ভোক্তা অধিকার পায় সে জন্য ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব, দুদক এবং নৌ-মন্ত্রণালয় সমন্বয় করে কাজ করে যেতে হবে। ফলে আমরা সম্ভাব্য সব বিপদ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চালাতে পারব।
প্রতিনিয়ত এমন সব দুর্ঘটনা আমাদের মোটেও কাম্য নয়। আমাদের দেশ উন্নত হচ্ছে ঠিকই, তবে এসব দিকেও আরও ঢালাওভাবে সরকারের নজর দরকার। কারণ প্রতিনিয়ত সড়ক কিংবা নৌ-দুর্ঘটনার ফলে জনমনে যে ভীতি বা আশঙ্কার উদয় হয়ে অশান্তি বিরাজ করে, সেসব দিয়ে আমরা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না। দেশে যখন শান্তি এবং উন্নয়ন একই সঙ্গে অবস্থান করবে, তখনই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবের রূপ পাবে। তাই সরকার যদি জনমনে শান্তি আনয়নই করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে অর্থনৈতিক এবং অবকাঠামোর দিক দিয়ে এত উন্নত হয়ে লাভ কী?
শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়