রহমত রহমান: প্রায় ৯ বছর আগে পায়রা বন্দর চালু হয়েছে। প্রতিনিয়ত এই বন্দরে দেশি-বিদেশি জাহাজের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে আমদানি। সঙ্গে বাড়ছে রাজস্ব আদায়। তবে আমদানিকারক ও বন্দর ব্যবহারকারীরা কাক্সিক্ষত রাজস্ব সেবা পাচ্ছে না। কারণ এখানে পূর্ণাঙ্গ কাস্টম হাউস নির্মিত হয়নি। যদিও সাত বছর আগে ২০১৬ সালে এনবিআর পায়রা বন্দরের অন্তর্ভুক্ত এলাকাগুলোকে কাস্টম হাউস পায়রা’র অধিক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণা করে। বর্তমানে খুলনা ভ্যাট কমিশনারেটের অধীনে এই বন্দরে কাস্টমস সেবা দেয়া হচ্ছে। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, দেশের তৃতীয় এই বন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম নেয়া হয়েছে। ফলে বন্দর ব্যবহার বাড়ছে। তবে পূর্ণাঙ্গ কাস্টম হাউস না থাকায় সংশ্লিষ্টরা কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছে না। সেজন্য দ্রুত পূর্ণাঙ্গ কাস্টম হাউস নির্মাণের অনুরোধ জানানো হয়েছে। তবে এনবিআর বলছে, এখনও পূর্ণাঙ্গ কাস্টম হাউস নির্মাণের সময় হয়নি। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেলে পূর্ণাঙ্গ কাস্টম হাউস নির্মাণ করা হবে।
এনবিআর সূত্রমতে, পায়রা বন্দরে পূর্ণাঙ্গ কাস্টম হাউস নির্মাণ করার অনুরোধ জানিয়ে ২০২৩ সালের ৮ আগস্ট অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগকে চিঠি দেয় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। ৪ ডিসেম্বর নৌ-পরিবহন সচিবের কাছে চিঠির জবাব পাঠানো হয়, যাতে বলা হয়, এনবিআরে অধীনস্থ শুল্ক, আবগারি ও ভ্যাট অনুবিভাগের পুনর্গঠন ও সম্প্রসারণের জন্য জনবল বৃদ্ধি করার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এতে বরিশাল বিভাগের ভৌগোলিক বা প্রশাসনিক অঞ্চল নিয়ে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, বরিশাল নামে একটি পৃথক কমিশনারেট গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে ২৭৭ জন জনবল নিয়োগ করা হবে। ওই কমিশনারেটের আওতায় একজন যুগ্ম কমিশনার পর্যায়ের কর্মকর্তাকে প্রধান করে প্রাথমিকভাবে ৭০ জন জনবল নিয়ে পায়রা শুল্ক স্টেশন স্থাপন করা হবে। পায়রা বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেলে এই বন্দরে একটি পূর্ণাঙ্গ কাস্টম হাউস নির্মাণের কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।
অপরদিকে চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ পায়রা বন্দরে পূর্ণাঙ্গ কাস্টম হাউস নির্মাণের বিষয়ে সহায়তা চেয়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। তাতে বলা হয়, ২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রা বন্দর উদ্বোধন করেন। এ বন্দরের রয়েছে আর্থিক, বাণিজ্যিক ও সামাজিক উন্নয়নের বহুমুখী সম্ভাবনা। বন্দর সেবার ক্ষেত্রে কাস্টমস একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যকীয় সেবা। সেবার পাশাপাশি বন্দর অপারেশন থেকে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ উল্লেখযোগ্য রাজস্ব আহরণ করে থাকে। চট্টগ্রাম বন্দরে কাস্টমস সেবা প্রদানের জন্য কাস্টম হাউস, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে কাস্টমস সেবা প্রদানের জনা কাস্টম হাউস, মোংলা কাজ করে যাচ্ছে। দেশের তৃতীয় আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর হিসেবে পায়রা বন্দরে পূর্ণাঙ্গ কাস্টমস সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পায়রা কাস্টম হাউস নির্মাণের জন্য এনবিআর ২০১৬ সালের ২ আগস্ট পায়রা বন্দরের অন্তর্ভুক্ত এলাকাগুলোকে কাস্টম হাউস পায়রা’র অধিক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণা করে।
আরও বলা হয়, পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বন্দর চ্যানেলের নাব্য ১০ মিটারে উন্নীতকরণ, মাল্টিপারপাস টার্মিনাল, সংযোগ সড়ক ও আন্ধারমানিক নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের কাজ, আধুনিক জেটি, ইয়ার্ড, ওয়্যারহাউস, ইকুইপমেন্ট প্রভৃতি উন্নয়নের কাজ বাস্তবায়ন। ফলে বর্তমানে বন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
চিঠিতে বলা হয়, দেশের অন্যতম বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ ও বসুন্ধরা গ্রুপ পায়রা বন্দরের মাধ্যমে এরই মধ্যে আমদানি কাজ শুরু করেছে। বিসিআইসি, খাদ্য অধিদপ্তর, বিএডিসি, টিকে গ্রুপ ও অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পায়রা বন্দরের মাধ্যমে আমদানি কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করছে, যা বন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্প্রসারণের সম্ভাবনা ও পায়রা বন্দরের মাধ্যমে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রাজস্ব আহরণের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে পায়রা বন্দরের জন্য পূর্ণাঙ্গ কাস্টম হাউস স্থাপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যকীয়।
পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রাকৃতিক চ্যানেলে পায়রা বন্দরের মাধ্যমে ৪০০টি বৈদেশিক বাণিজ্যিক জাহাজ অপারেশন করা হয়। এর মাধ্যমে সরকারের প্রায় এক হাজার ১০৫ কোটি টাকা রাজস্ব আহরিত হয়। বন্দরের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্প্রসারণের ফলে পায়রা বন্দর থেকে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের রাজস্ব আহরণ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এ কারণে পায়রা বন্দরে দ্রুততম সময়ে পূর্ণাঙ্গ কাস্টম হাউস নিশ্চিত করা জরুরি প্রয়োজন।
চিঠিতে আরও বলা হয়, বন্দরের অংশীজনদের মতবিনিময় সভায় বন্দর ব্যবহারকারীরা পায়রা বন্দরে দ্রুততম সময়ে পূর্ণাঙ্গ কাস্টম হাউস নিশ্চিত করার বিষয়ে বারবার অনুরোধ করেছেন। সভায় কাস্টমস বিভাগের প্রতিনিধিকে বন্দর অপারেশন কাজে সব ধরনের কাস্টমস সেবা ও সহযোগিতা প্রদান করার অনুরোধ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পায়রা বন্দরে মাল্টিপারপাস ভবনে কাস্টমস বিভাগের জন্য অফিস সুবিধা প্রদানসহ কাস্টমস কর্মকর্তাদের বাসস্থান সুবিধা বন্দর থেকে প্রদান করা হয়। এর ফলে বর্তমানে পায়রা বন্দর এলাকায় অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম সুবিধা চালুসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য কাস্টমস সেবা প্রদান করা যাচ্ছে, যা পায়রা বন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অত্যন্ত ইতিবাচক গুরুত্ব বহন করে।
আরও বলা হয়, পায়রা বন্দরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পায়রা কাস্টম হাউস নির্মাণ করার বিষয়ে ২০২৩ সালের ২৫ জুলাই নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আধুনিক ও স্মার্ট আন্তর্জাতিক বন্দর হিসেবে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দ্রুত পায়রা বন্দরে একটি পূর্ণাঙ্গ কাস্টম হাউস নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এছাড়া পায়রা বন্দরের চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে ৮ আগস্ট বন্দরের সভাকক্ষে খুলনা ভ্যাট কমিশনারের উপস্থিতিতে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় একটি আন্তর্জাতিক বন্দর হিসেবে পায়রা বন্দরে দ্রুততম সময়ে পূর্ণাঙ্গ কাস্টম হাউস স্থাপন জরুরি বলে সবাই ঐকমত্য পোষণ করেন। এ বিষয়ে পায়রা কাস্টম হাউস নির্মাণের জন্য কমিশনার বন্দর থেকে ১২-১৫ একর জমি লিজ প্রদানের বিষয়ে অনুরোধ করেন। বন্দরে কাস্টম হাউস নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা ও জরুরি গুরুত্বের বিষয়টি বিবেচনা করে বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দরের টার্মিনাল-সংলগ্ন জেনারেল পোর্ট ফ্যাসিলিটিজ এলাকায় ১৫ একর জমি লিজ প্রদানের বিষয়ে প্রাথমিকভাবে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যার বাস্তবায়নের কাজ চলমান আছে।
চিঠিতে বলা হয়, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ৪ ডিসেম্বর যে চিঠি দিয়েছে, তাতে উল্লেখ করেছে, বরিশাল ভ্যাট কমিশনারেটের (প্রস্তাবিত) অধীনে ৭০ জন জনবল নিয়ে পায়রা শুল্ক স্টেশন নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক বন্দর অপারেশন কাজে কাস্টমস সেবার কার্যপরিধি, গুরুত্ব এবং এ লক্ষ্যে এনবিআর পায়রা কাস্টম হাউসের গেজেট আকারে ঘোষিত পায়রা বন্দর এলাকাগুলোকে কাস্টম হাউস, পায়রা’র অধিক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ, যার ফলে পায়রা বন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা ও পায়রা বন্দরের মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকারের লক্ষ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কাস্টম হাউস নির্মাণে এনবিআরকে আবার চিঠি দেয়ার অনুরোধ জানায় পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ।
অপরদিকে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের এই চিঠি অনুযায়ী ২৪ জানুয়ারি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এনবিআর চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয়, যাতে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ পূর্ণাঙ্গ কাস্টম হাউস নির্মাণের যেসব রাজস্ব সম্ভাবনার বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, তা এনবিআর চেয়ারম্যানকে দেয়া চিঠিতেও তুলে ধরেছে মন্ত্রণালয়। এছাড়া এনবিআর ঘোষিত গেজেটের আলোকে পায়রা বন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণ ও দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিষয়টি বিবেচনা করে পায়রা বন্দরে দ্রুত পূর্ণাঙ্গ কাস্টম হাউস নির্মাণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়।
পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে এই বন্দরে ২৫টি বিদেশি ও ১৮০টি দেশি জাহাজ পণ্য নিয়ে এই বন্দরে এসেছে। এতে বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রায় সাত কোটি ৬৭ লাখ টাকা বন্দর চার্জ পেয়েছে। এছাড়া ভ্যাট আদায় হয়েছে এক কোটি ১৫ লাখ টাকা।