নিয়াজ মাহমুদ: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত উত্তরা ব্যাংকের মোট শেয়ারের ৩০ শতাংশ সম্মিলিতভাবে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের নেই। অন্যদিকে ১০ জন শেয়ারহোল্ডারধারী পরিচালকের মধ্যে পৃথকভাবে ছয়জনেরই নেই কোম্পানির ন্যূনতম দুই শতাংশ শেয়ার। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে বলে জানা গেছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বিধান অনুযায়ী, পরিচালকের ন্যূনতম দুই শতাংশ শেয়ার ধারণে ব্যর্থ উত্তরা ব্যাংকের পরিচালকরা হলেনÑপ্রকৌশলী তোফাজ্জল হোসেন, আবুল বারক আলভী, এম তাজুল ইসলাম, এম এস কামাল, ফারুক আলমগীর ও শেখ আবদুল আজিজ। ব্যাংকটির পর্ষদে মোট ১৪ জন সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে তিনজন স্বতন্ত্র পরিচালক ও পদাধিকার বলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পর্ষদ সদস্য।
ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত উত্তরা ব্যাংকের মোট শেয়ারের ১২ দশমিক ৫৮ শতাংশ শেয়ার রয়েছে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ২০ দশমিক ৩৫ শতাংশ শেয়ার। দুই দশমিক ২২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিকট। বাকি ৬৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।
জানা গেছে, শেয়ারধারী ১০ জন পরিচালকের মধ্যে চারজনের পৃথকভাবে দুই শতাংশের বেশি শেয়ার রয়েছে। তারা হলেন- চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলাম, ইফতেখারুল ইসলাম, আরিফ রহমান ও আসিফ রহমান। বাকি ছয়জন পরিচালকের এককভাবে উত্তরা ব্যাংকের দুই শতাংশের কম শেয়ার রয়েছে।
গত জুন শেষে ডিএসইর তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, উত্তরা ব্যাংকের পরিচালক প্রকৌশলী তোফাজ্জল হোসেনের কাছে ব্যাংকটির ৪০ হাজার ৭৫টি শেয়ার রয়েছে; যা মোট শেয়ারের ০ দশমিক শূন্য এক শতাংশ। আবুল বারক আলভীর নামে শেয়ার রয়েছে ৩৯ হাজার ৯৪৯টি শেয়ার রয়েছে। তার হাতে থাকা শেয়ার কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ০ দশমিক শূন্য এক শতাংশেরও কম।
উত্তরা ব্যাংকের পরিচালক এম তাজুল ইসলামের কাছে কোম্পানিটির মোট শেয়ার রয়েছে ১৯ হাজার ৮৭০টি। আরেক পরিচালক কর্নেল প্রকৌশলী এমএস কামালের (অব.) কাছে শেয়ার রয়েছে মাত্র ৪০ হাজার ৭৪টি। যা কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ০ দশমিক শূন্য এক শতাংশেরও কম। ফারুক আলমগীরের কাছে উত্তরা ব্যাংকের শেয়ার রয়েছে তিন হাজার ৩৩৯টি শেয়ার। অপর এক পরিচালক শেখ আবদুল আজিজের নামে রয়েছে উত্তরা ব্যাংকের মাত্র চার হাজার শেয়ার। গত জুনের পর থেকে এসব পরিচালকরা ব্যাংকটির কোনো শেয়ারও ক্রয় করেননি। তবুও তারা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালক পদে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালন করছেন।
এ প্রসঙ্গে ডিএসইর সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান পরিচালক রকিবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘কোনো কোম্পানির মালিকানায় পরিচালকদের অংশগ্রহণ বেশি থাকলে কোম্পানির প্রতি তাদের আগ্রহ ও দায়িত্ববোধও বেশি থাকে। তাই এ বিষয়ে সব পক্ষকে কঠোর হওয়া উচিত।’
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের অধিকাংশই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে থাকায় বাজারে শেয়ারের চাহিদা কমে যাচ্ছে। ফলে প্রকৃত শেয়ারমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। প্রত্যেক পরিচালকের হাতে ২ শতাংশ ও সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকার কথা থাকলেও আইনটি মানছে না অনেক কোম্পানির পরিচালক।
উল্লেখ্য, ২০০৯ ও ২০১০ সালে চাঙ্গা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির অনেক উদ্যোক্তা-পরিচালক হাজার হাজার কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীতে ২০১১ সালের ২২ নভেম্বর উদ্যোক্তা-পরিচালকদের ন্যূনতম শেয়ার ধারণের শর্ত বেঁধে দিয়ে নির্দেশনা জারি করে বিএসইসি। এ নির্দেশনাটি জারির পর থেকেই বিভিন্ন কোম্পানি, বিশেষ করে ব্যাংকের পরিচালকরা ন্যূনতম শেয়ার ধারণের শর্ত থেকে ব্যাংকগুলোকে অব্যাহতি দেয়ার দাবি জানান। সে সময় কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালক বিএসইসির বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলাও করেন। মামলায় হেরে গিয়ে পর্ষদের সদস্যপদও ছাড়তে হয় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক পরিচালকদের।
বিধান অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর পরিচালকদের প্রত্যেকের (স্বতন্ত্র পরিচালক ব্যাতীত) পরিশোধিত মূলধনের দুই শতাংশ শেয়ার ধারণ বাধ্যতামূলক। তবে তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানিই রয়েছে; যাদের পরিচালকদের প্রত্যেকেরই দুই শতাংশ শেয়ার ধারণ করছেন না। এই অবস্থায় তারা কোম্পানির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
কমিশন বলছে, এ ধরনের পরিচালকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর এ বিষয়টি এমফোর্সমেন্টে পাঠানোর জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। অন্যদিকে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকের (স্বতন্ত্র পরিচালক ব্যাতীত) মোট পরিশোধিত মূলধনের ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে যারা ব্যর্থ হয়েছেন; ওই সব কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের উল্লেখিত শেয়ার ধারণ নিশ্চিতকরণের জন্য নির্দেশনা জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। পরিচালকদের প্রত্যেকের (স্বতন্ত্র পরিচালক ব্যতীত) পরিশোধিত মূলধনের দুই শতাংশের নিচে শেয়ারধারীদের শাস্তির আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি। শুধু উত্তরা ব্যাংক নয়, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ২১৯ জন পরিচালক ন্যূনতম শেয়ার ধারণে ব্যর্থ। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে কমিশন। অন্যদিকে সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার উদ্যোক্তা-পরিচালকদের নেই ৭৮টি কোম্পানির। এ সংক্রান্ত সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনকারী পরিচালক ও কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।