নাজমুল হুসাইন: আবারও পচা মাংস বিক্রির অভিযোগে এসিআইয়ের সুপারশপ ‘স্বপ্ন’কে জরিমানা করা হয়েছে। গতকাল ধানমন্ডির গ্রিন রোডে জরিমানার সময় ওই আউটলেট থেকে ১৫ কেজি পচা খাসির মাংস জব্দ করা হয়। এ সময় স্বপ্নের ধানমন্ডি আউটলেটকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ টিম এ অভিযান পরিচালনা করে।
পচা মাংসগুলো বিক্রির জন্য প্রদর্শন করা ছিল। পড়ে স্বপ্নের ওই আউটলেটের কর্মকর্তারা প্রশাসনের কাছে এ ধরনের মাংস বিভিন্ন হোটেলে সরবরাহ করা হয় বলে জানান। গত এক বছরে একই অভিযোগে ১০ বার জরিমানা করা হয় স্বপ্নকে।
এসিআই লজিস্টিক লিমিটেড ২০০৮ সালে বাংলাদেশে স্বপ্ন সুপার শপের ব্যবসা শুরু করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সুপার শপটির বিরুদ্ধে মানহীন খাদ্য বিক্রি, অনিয়ম ও ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণামূলক প্রচুর অভিযোগ উঠেছে। প্রতি মাসে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে স্বপ্নের বিরুদ্ধে একাধিক ভোক্তা প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের নানা অভিযোগ আসছে এবং তা প্রমাণিতও হচ্ছে। আর সেসব প্রমাণিত অভিযোগের জন্য শুধু জরিমানা গুনেই পার পেয়ে যাচ্ছে সুপারশপটি।
অভিযোগ আছে, দেশে পরিচালিত বিভিন্ন সুপারশপের মধ্যে ভোক্তা প্রতারণার শীর্ষে রয়েছে স্বপ্ন। ফরমালিন দিয়ে পচা মাছ এবং বিদেশি নামে দেশের তৈরি অনুমোদনহীন স্ট্যান্ডার্ড মার্ক (বিএসটিআই সিল) ব্যবহার, মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি করে থাকে তারা। ইদানীং পচা মাছ-মাংস বিক্রি এই সুপার শপের নিত্যদিনের ঘটনা। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত এক বছরে শুধু পচা মাছ-মাংস বিক্রির জন্য ১০ বার জরিমানা করা হয়েছে স্বপ্নকে।
শুধু মোবাইল কোর্টের এমন অভিযানেই নয়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে আসা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তদন্তের পরও স্বপ্নের পচা মাছ-মাংস বিক্রির প্রমাণ মিলেছে। এতে স্বপ্ন কর্তৃপক্ষ জরিমানা প্রদান ও ভবিষ্যতে মানসম্পন্ন পণ্য বিপণনের প্রতিশ্রুতিস্বরূপ মুচলেকাও দিয়েছে। তবু বন্ধ হচ্ছে না তাদের এ ধরনের কার্যক্রম।
গতকাল জরিমানার পর জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আবদুল জব্বার শেয়ার বিজকে বলেন, স্বপ্নের গ্রিন রোডে অবস্থিত শাখায় অভিযানের সময় সেখানে ১৫ কেজি পচা খাসির মাংস পাওয়া যায়, যা হিমায়িত ডিসপ্লেতে বিক্রির জন্য সাজানো ছিল। সেখান থেকে বের করার কিছুক্ষণ পর ওই মাংস থেকে পচা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এতে স্বপ্নকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
অভিযানে উপস্থিত থাকা ওই অধিদফতরের আরেক সহকারী পরিচালক প্রণব কুমার প্রামাণিক বলেন, নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবেই অভিযানটি চালানো হয়। এর আগেও একই অভিযোগে স্বপ্নকে অনেকবার জরিমানা করা হয়েছে। তারা বিভিন্ন অভিযোগে দোষও স্বীকার করছে। আজকে পাওয়া এসব পচা মাংস তারা বিভিন্ন হোটেলে কম দামে সরবরাহ করা হয় বলে স্বীকার করে।
এদিকে মাত্র কয়েকদিন আগেই গত ২৬ ফেব্রুয়ারি পচা মুরগির মাংস বিক্রির অভিযোগে ভোক্তা অধিকার আইনে তাদের অভিযোগ তদন্তের পরে প্রমাণিত হয়। সিলেট জিন্দাবাজারে স্বপ্নের আউটলেট থেকে ওইসব পচা মুরগি বিক্রি করা হয়েছিল ওই এলাকার মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির পরিচালক তারেক ইসলামের কাছে। তখন তিনি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করেন। সেই অভিযোগ তদন্তে সত্যতা মেলে, স্বপ্ন কর্তৃপক্ষও তাদের বক্তব্যে তা স্বীকার করে। তখন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর ৫১ ধারায় ওই আউটলেটকে জরিমানা করা হয় এবং ভবিষ্যতে মানসম্পন্ন পণ্য বিপণনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে স্বপ্ন কর্তৃপক্ষের কাছে মুচলেকা নেওয়া হয়।
শুধু ভোক্তা অধিকারই স্বপ্নের অভিযোগ প্রমাণ পায় তেমন নয়, সেই ঘটনার দুমাস আগে গত বছরের ৭ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানীতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতে স্বপ্নে একইসঙ্গে পচা মাছ ও মাংস হিমায়িত রাখা এবং প্যাকেটের তারিখ ও মেয়াদ উল্লেখ না থাকায় অভিযোগে স্বপ্নকে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
তার আগের মাসে ৮ নভেম্বর একই দিনে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন-৫) অপারেশনস অফিসার এসি সাইদুর রহমান ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন অভিযোগে ৫ লাখ ৩২ হাজার টাকা জরিমানা করেন। ওই দফায় গুলশান-১ এর স্বপ্নের আউটলেটে বিএসটিআই অনুমোদনহীন পণ্যসহ পচা মাছ বিক্রয় করায় ব্যবস্থাপক রোনাল ডি রোজারিও এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
এর আগে স্বপ্ন জরিমানা গুনেছে ১৬ অক্টোবর ২০১৬। অপরাধ একই ধরনের। বনানী এলাকায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাজিদ আনোয়ার ওই অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানে মেয়াদোত্তীর্ণ ও নি¤œমানের পণ্য রাখা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ও অননুমোদিতভাবে একই ফ্রিজে বিভিন্ন ধরনের পণ্য সংরক্ষণ এবং পশু জবাইয়ের স্থানে নোংরা পরিবেশ থাকায় জরিমানা করা হয়।
এসব জরিমানায় টনক নড়েনি স্বপ্নের। নভেম্বরে যে গুলশান-১ আউটলেট জরিমানা গুনেছিল, একমাস আগে সেপ্টেম্বরেও সেই আউটলেটেই এপিবিএন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে গঠিত ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়েছিল। সে দফায় ওই ব্যবস্থাপক রোনাল ডি রোজারিও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিয়েছিল।
এভাবে বিভিন্ন সংস্থার তথ্য আরও বলছে, গত বছরের ১৪ আগস্ট স্বপ্নের খিলগাঁও আউটলেট, ২৮ জুন বিজয়নগর আউটলেট, ২৭ এপ্রিল ফেনী শহর আউটলেট, ১০ মার্চ খামারবাড়ি মণিপুরীপাড়া আউটলেট পচা মাছ-মাংস বিক্রিসহ অন্যান্য অভিযোগে জরিমানা গুনেছে। তবে এসব বিষয়ে এসিআই লজিস্টিক লিমিটেডের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির ভুইয়া বলেন, আর্থিক জরিমানা করে এসব প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম বন্ধ করা যাবে না। এমন অপরাধ এখন প্রতিনিয়তই করছে এসব সুপারশপ। আর জরিমানা দিয়ে পার হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মূল হোতাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এতে আইনেরও দুর্বলতা রয়েছে।
Add Comment