মো. মাসুম বিল্লাহ: একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে যেসব বিষয় জোরালো ভূমিকা রাখে তার মধ্যে অন্যতম সরকারি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই। বাংলাদেশও তাই পরিকল্পনা প্রণয়নকালে এফডিআইয়ের ওপর বেশ জোর দিয়ে থাকে। প্রতিটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এফডিআইয়ের একটি প্রক্ষেপণ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নির্ধারিত এফডিআইয়ের কোনো লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। বর্তমানে চলমান অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও একই চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রকল্পের প্রথম বছর ২০২০-২১ অর্থবছরে এফডিআইয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল জিডিপির শূন্য দশমিক ৮৩ শতাংশ। এর বিপরীতে অর্জিত হয় মাত্র শূন্য দশমিক তিন শতাংশ। অর্থের পরিমাণে যা মাত্র আড়াই বিলয়ন ডলার। এর পরের অর্থবছরগুলোয় ক্রমবর্ধমান হারে এফডিআইয়ের প্রক্ষেপণ বাড়ানো হয়েছে পরিকল্পনায়। কিন্তু সেই প্রক্ষেপণের ধারেকাছেও নেই প্রকৃত এফডিআই। ২০২১-২২ অর্থবছরে এফডিআইয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল জিডিপির এক দশমিক ৩৫ শতাংশ। এর বিপরীতে অর্জন মাত্র শূন্য দশমিক চার শতাংশ। অর্থের পরিমাণে এটি তিন দশমিক চার বিলিয়ন ডলার। এর পরের অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল জিডিপির এক দশমিক ৯ শতাংশ। এর বিপরীতে অর্জন শূন্য দশমিক ছয় শতাংশ।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে এফডিআইয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে জিডিপির আড়াই শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে জিডিপির তিন শতাংশ। কিন্তু এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনযোগ্য নয়। এমন পরিস্থিতিতে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এফডিআইয়ের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করেছে পরিকল্পনা কমিশন। কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মধ্যবর্তী পর্যালোচনায় এরই মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য দশমিক আট শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জন্য এক শতাংশ এফডিআই আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রাচ্যের দেশ দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশের উন্নয়নে এফডিআইয়ের বড় ভূমিকা ছিল। এমনকি সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট মিয়ানমারেরও বাংলাদেশের চেয়ে এফডিআইয়ের পরিমাণ বেশি। এমনকি বৈশ্বিক পর্যায়ে প্রতি বছর যে পরিমাণ এফডিআই প্রবাহ রয়েছে, তার ছিটেফোটাও বাংলাদেশে আসছে না।
২০১৮ সালে মোট বৈশ্বিক এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল এক দশমিক তিন ট্রিলিয়ন ডলার বা এক লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার। এর মধ্যে ৭০ হাজার ৬০০ কোটি ডলার এসেছিল উন্নয়নশীল দেশগুলোয়। তার মধ্যে বাংলাদেশে এসেছিল মাত্র ২৫৮ কোটি ডলার, যা মোট বৈশ্বিক এফডিআইয়ের অনুপাতে খুবই নগণ্য।
বাংলাদেশে এফডিআইয়ের পরিমাণ কেন আশানুরূপ নয় এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী কোন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে তার পুঁজির নিরাপত্তা চান। সেই নিরাপত্তা বলতে বোঝায় যে, তিনি নিজের মতো করে বিনিয়োগ করতে পারবেন কি না এবং নিজের ইচ্ছামতো তার বিনিয়োগ করা অর্থ ও বিনিয়োগের মুনাফা নিজ দেশে নিয়ে যেতে পারবেন কি না। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এ দেশের বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিনিয়োগের শর্ত রয়েছে। এ শর্ত তারা মানতে নারাজ। আবার অনেক বিষয় আছে যেগুলো আইনে নেই। কিন্তু বিনিয়োগ করতে গেলে নানা অলিখিত নিয়মের বেড়াজালে পড়তে হয়। এর বাইরে পছন্দের জায়গায় জমির প্রাপ্যতা, দক্ষ শ্রমিকের প্রাপ্যতা, অবকাঠামোসহ বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব বিষয় সমাধান করা না গেলে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা সম্ভব হবে না।’
বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বেশিকিছু নীতি পদক্ষেপের উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে সেসব উদ্যোগ তেমন বাস্তবায়ন হয়নি। পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল যে, দক্ষ সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখা হবে। কিন্তু গত অর্থবছরের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশে লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। এ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উগ্যোগগুলো কার্যত কোনো ফল দেয়নি। পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল যে একটি প্রতিযোগিতামূলক ও স্থিতিশীল বিনিময় হার প্রতিষ্ঠা করা হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটি করা হয়নি। বর্তমানে বাজারে চার ধরনের বিনিময় হার বিদ্যমান। এছাড়া পরিকল্পনায় বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হলেও চলতি অর্থবছরের বাজেটে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমানো হয়েছে। এছাড়া ব্যবসার খরচ কমানো, উপযুক্ত অবকাঠামো সুবিধা প্রদান, সরকারি সেবা প্রদান সহজীকরণসহ বেশকিছু ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা পরিকল্পনায় বলা হলেও বাস্তবতা তা সুদূর পরাহত।
এ বিষয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, পরিকল্পনা থাকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। যেসব উদ্যোগের কথা পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা না হলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হবে না।