নিজস্ব প্রতিবেদক: গণ-আন্দোলনের মুখে সরকার পরিবর্তনের ফলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনার যে সুযোগ উšে§াচিত হয়েছে, তা সর্বোত্তমভাবে কাজে লাগাতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান নতুন করে প্রতিস্থাপন করতে হবে। এছাড়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নবগঠিত সরকারের সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য একটি আলাদা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি রাজনীতিতে যেন পেশি শক্তির আবির্ভাব না ঘটে, সে বিষয়টি নিশ্চিতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক সংলাপে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা এসব প্রস্তাব তুলে ধরেছেন। রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়: নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক সংলাপে বক্তারা এসব প্রস্তাব দেন। অনুষ্ঠানে সাবেক অর্থ সচিব মুসলিম চৌধুরী দাবি করেন, বর্তমানে দেশের সংবিধানে স্বৈরাচারী হওয়ার অনেক উপাদান আছে, এগুলো বাদ দিতে হবে। এগুলো রাজনৈতিক দলের হাতে ছেড়ে দিলে আমরা ব্লাকহোলে পড়ে যাব। তিনি আরও দাবি করেন, ডিক্টেটোরিয়াল উপাদান বাদ দিতে হবে। স্থানীয় সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে আলাদা করতে হবে। তার বক্তব্যের মাঝেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম মুসলিম চৌধুরীকে প্রশ্ন করেন, আপনি কি সংবিধানের সংশোধন চাচ্ছেন নাকি নতুন করে লিখতে বলছেন। জবাবে মুসলিম চৌধুরী বলেন, এ সংবিধান সংশোধন সম্ভব না, এটাকে আবার লিখতে হবে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, এ সরকারকে নতুন করে সংবিধান লিখে যেতে হবে, তারা হয়তো বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। তারা পরবর্তী সরকারের জন্য এ সংবিধান লিখে যেতে হবে যাতে তারা বাস্তবায়ন করতে পারেন। সিপিডির ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ১৯৯০ সালে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে একটি পথনকশা তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু পরে সেটা ধ্বংস করা হয়েছে, আকাক্সক্ষা পূরণ হয়নি। এবারের শিক্ষার্থী-গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে যে আকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে, যে সংস্কার কার্যক্রমের কথা বলা হয়েছে এর মাধ্যমে একটি অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। এটা করতে হলে যে শিক্ষার্থীরা এ অভ্যুত্থান করল তাদের উপস্থিতি জরুরি।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হবে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা। সেনাবাহিনী থেকে বলা হচ্ছে অনেকে হেফাজতে আছেন। কারা কারা হেফাজতে আছেন তাদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। তিনি বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, তার বিচার হওয়া দরকার। সাত শতাধিক মানুষ নিহত ও হাজারও মানুষ আহত হয়েছেন।
এই নিহতের ঘটনায় ফৌজদারি ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতে হবে। অর্থনৈতিক অপরাধের বিচার করতে হবে। দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার করেছে, তার বিচার করতে হবে। দলীয় বাহিনীকে সংস্কার করে রাষ্ট্রীয় বাহিনীতে পরিণত করতে হবে। প্রধান বিচারপতি নিয়োগ পদ্ধতিটা সঠিক হয়নি মন্তব্য করে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, হাইকোর্ট থেকে সরাসরি প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর এখন অনেকে প্রধান বিচারপতি হওয়ার জন্য ধরণা দেবেন। উচিত ছিল নতুন প্রধান বিচারপতিকে আপিল বিভাগে নিয়ে তারপর তাকে প্রধান বিচারপতি করা। তিনি বলেন, এই অন্তবর্তী সরকারের সফল হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। অনেকগুলো সংস্কার, আইন করতে হবে। এগুলো করতে হলে একটি নাগরিক সমঝোতা করার দরকার, যাতে এ সরকার পুরোপুরি করতে না পারলেও পরবর্তী সরকার করে, থামিয়ে দিতে না পারে।
পুলিশ বাহিনীকে দলীয় থেকে সরকারি বাহিনী করা দরকার উল্লেখ করে সুজন সম্পাদক আরও বলেন, ‘যারা প্রাথমিকভাবে নিপীড়নের দোসর ছিল তাদের বাদ দিয়ে বঞ্চিতদের নিয়ে বাহিনীর সংস্কার করা জরুরি। আরেকটি বিষয় হলো প্রশাসন, সেখানেও সংস্কার জরুরি। পিএসসি পরীক্ষায় অনেকে উত্তীর্ণ হলেও পুলিশ ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে নিয়োগ আটকে দেওয়া হয়েছে। যেকোনো নিয়োগে পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। উপদেষ্টা পরিষদের সফল হতেই হবে। তারা ব্যর্থ হলে আমরাও ব্যর্থ হয়ে যাব।’ স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, সরকারের সবাই পদত্যাগ করেছে কিন্তু সচিবদের কেউ পদত্যাগ করেননি। এটা দেখতে হবে। তিনি আরও বলেন, এতগুলো মন্ত্রণালয় ড. ইউনূসের নিয়ন্ত্রণে রাখার দরকার নেই। এসব সরকারের অনেকের ভিত্তি এনজিও। সরাসরি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মাত্র তিনজন। যারা ভালো রাজনীতি বোঝেন, যারা প্রশাসন বোঝেন তাদের সরকারে রাখতে হবে। তা না হলে প্রশাসন বুঝতে বুঝতেই সময় চলে যাবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নুশরাত তাবাসসুম বলেন, প্রথম যখন কথা ছিল তখন ছাত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সেটাও ছাত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। আমরা চেয়েছিলাম শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য দূর হলে পুরো সমাজে এর প্রভাব পড়বে। নুসরাত বলেন, এমন সিসটেম আনতে হবে, যাতে ক্যাডার বাহিনী গড়ে না ওঠে। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা দুশ্চিন্তায় আছেন। শিক্ষক, অভিভাবকদের নিয়ে বসে একটি যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়তে হবে। নুসরাত তাবাস্সুম বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা সবার আগে ঠিক করা দরকার। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সংস্কার প্রয়োজন। সবচেয়ে বেশি গোয়েন্দা বিভাগের দিকে নজর দেওয়া উচিত। আমাদের যখন নেয়া হয়, তখন গোয়েন্দা বিভাগের দুর্নীতি নজরে এসেছে। একটা আয়না ঘরের খবর জেনেছি। গোয়েন্দা বিভাগে আর কোনো আয়না ঘর আছে কি না, সেটা দেখা দরকার।’
তিনি বলেন, ‘ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউট সবচেয়ে খারাপ হাতিয়ার। ওই সময়ে অনেক জঘন্যতম অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আইটি সেক্টরে।’
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ফাহিম মাসরুর বলেন, যে বৈষম্য শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ করে এবং আন্দোলনের মতো ঐক্যের দিকে ঠেলে তা হলো, ২০১৫ সালের বৈষম্যমূলক পে কমিশন। ২০১৫ সালে এক ধাপে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়। এর ফলে বেসরকারি কর্মীদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি হয়। বৈষম্য তৈরি হয় অর্থনীতিতে। সরকারি খাতে এত বেতন বাড়ানো হলো কিন্তু সেই বেতন দেয়ার মতো ক্ষমতা বেসরকারি খাতের ছিল না। ফলে সেখানে এক ধরনের অস্বস্তিতে পড়ে। এর থেকে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবি প্রাধান্য পায়। দানা বাঁধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। এই বৈষম্য দূর করতে হলে প্রয়োজনে সরকারি কর্মীদের বেতন কমিয়ে সরকারি-বেসরকারিদের সমান করতে হবে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘রাজস্ব আহরণের অপর্যাপ্ততা, সরকারি ব্যয় সংকুলানে ব্যর্থতা, এডিপি বাস্তবায়নে শ্লথগতি, ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের উচ্চমাত্রায় ঋণ দেশের অর্থনীতিকে চেপে ধরেছে।’ তিনি বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ, ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট, রপ্তানি আয়ে ধীরগতি, রেমিট্যান্স প্রবাহে মন্থরতা, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে স্থবিরতার মতো সমস্যাগুলোর দ্রুত অবসান করতে হবে। অর্থনীতির গতি আনতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অবক্ষয়, আমদানিতে ক্রমহ্রাসমান প্রবণতা, টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়ন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সমস্যাগুলো সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে।’
সামাজিক খাত পুনর্গঠনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম স্বাভাবিক করা, শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, শ্রমবাজারের চাহিদা ও দক্ষতার অসামঞ্জস্যতা দূর করার তাগিদ দেন তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষা খাতের পুনর্গঠনের সঙ্গে কর্মসংস্থান, বিশেষত যুব কর্মসংস্থানের, বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে।’