পণ্যের মিথ্যা বর্ণনাসহ চার কৌশলে অর্থ পাচার

নিজস্ব প্রতিবেদক: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে অর্থ পাচার। এ অর্থ পাচারের ৮০ শতাংশই হচ্ছে বাণিজ্যের মাধ্যমে। আমদানি-রফতানিতে পণ্য ও সেবায় ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিং; আমদানি-রফতানিতে বহুমাত্রিক ইনভয়েসিং; পণ্য ও সেবা সম্পর্কে মিথ্যা বর্ণনা; একইভাবে শিপমেন্টের ক্ষেত্রেও ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হচ্ছে। বিআইবিএমের গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গতকাল রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইনিস্টিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) অডিটোরিয়ামে ট্রেড সার্ভিস অপারেশনস অব ব্যাংকস শীর্ষক কর্মশালায় উপস্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে। কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান।
কর্মশালায় গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিআইবিএমের অধ্যাপক এবং পরিচালক (ট্রেনিং) ড. শাহ মো. আহসান হাবীবের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব পণ্য আমদানিতে কম শুল্ক দিতে হয়, বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রাংশ, শিল্পের কাঁচামাল এবং খুচরা যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে বেশি মূল্য দেখিয়ে অর্থ পাচার করা হয়। আবার সরকারি প্রণোদনা পেতে রফতানি পণ্যে বেশি মূল্য দেখানো হয়। বৈদেশিক বাণিজ্যের পাওনা পরিশোধে অসামঞ্জস্যতা প্রমাণ করছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং শুল্ক বিভাগের যৌথ উদ্যোগে অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম অর্থ পাচার প্রতিরোধে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে কর্মশালায় অতিথি হিসেবে আরও বক্তব্য রাখেন এনবিআরের শুল্ক মূল্যায়ন ও নিরীক্ষা কমিশনারেটের কমিশনার ড. মঈনুল খান; পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হেলাল আহমেদ চৌধুরী এবং এইচএসবিসির কান্ট্রি হেড অব গ্লোবাল ট্রেড অ্যান্ড রিসিভ্যাবলস ফিন্যান্স মোহাম্মদ শহিদুজ্জামান।
কর্মশালার উদ্বোধন করে ডেপুটি গভর্নর বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ট্রেড সার্ভিসের ওপর নির্ভরশীল। প্রত্যেকটি দেশে ট্রেড সার্ভিসের ক্ষেত্রে আলাদা রেগুলেশন রয়েছে। এক্ষেত্রে আমরাও নতুন গাইডলাইন করতে যাচ্ছি। তিনি বলেন, বর্তমানে ব্যবসাভিত্তিক অর্থ পাচার বাড়ছে। তবে অর্থ পাচার প্রতিরোধে কাজ করছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফইউ)। গত বছর থেকে ব্যাংকের সব কর্মকর্তাদের মানি লন্ডারিং বিষয়ে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। এ সময় এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার ক্ষেত্রে আমদানিকারকদের সবকিছু যাচাই-বাছাই করতে ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
এনবিআরের (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) এনবিআরের শুল্ক মূল্যায়ন ও নিরীক্ষা কমিশনারেট এর কমিশনার ড. মঈনুল খান বলেন, অর্থ পাচারের ৮০ শতাংশই ট্রেডের মাধ্যমে হচ্ছে। বর্তমানে এটা প্রতিরোধ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বাণিজ্যভিত্তিক অর্থ পাচার বন্ধ করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, অর্থ পাচার বন্ধে এলসি খোলার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তারা জড়িত হয়ে পড়ে। ব্যাংকগুলোকে অর্থ পাচারের কৌশল তদারকি করতে হবে। এক্ষেত্রে কাস্টমসের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর সমন্বয় দরকার। ৬৩৪টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে কাস্টমস। এ এসআরও ব্যাংকগুলো সংগ্রহ করতে পার। তাহলে এলসি করার ক্ষেত্রে সুবিধা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলি বলেন, এটি খুবই আশঙ্কার বিষয় যে, ৮০ শতাংশ অর্থ পাচারই ব্যাংকের মাধ্যমে হয়। শুধু অর্থ পাচারের ক্ষেত্রেই নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো মহা সমস্যায় আছে। এ সমস্যা সমাধানে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি বলেন, ঋণের সুদহার কমানোর কথা বলা হচ্ছে। ঋণের সুদহার কমালে আমানতের সুদহারও কমবে। তবে আমানতের সুদহার কখনও মূল্যস্ফীতির নিচে নামানো যাবে না। সম্প্রতি ব্যাংক মালিকরা নানা দাবি-দাওয়া আদায়ের ইস্যু তুলে তিনি বলেন, ব্যাংক মালিকরা নানা ইস্যু নিয়ে সরকারের কাছে যান। কিন্তু খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যাপারে তাদের উদ্যোগ কি? খেলাপি ঋণ আদায়ে এবং মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে তারা কি সরকারের কাছে সাহায্য চেয়েছেন?
এইচএসবিসি ব্যাংকের কান্ট্রি হেড অব গ্লোবাল ট্রেড অ্যান্ড রিসিভ্যাবলস ফিন্যান্স মোহাম্মদ শহিদুজ্জামান বলেন, অর্থ পাচার রোধে প্রথমেই ব্যাংককেই ভূমিকা পালন করতে হবে। ব্যাংক তার দায়িত্ব পালন করলেই অর্থ পাচার কমে আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম অফিসের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ হুমায়ূন কবির বলেন, বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক বাণিজ্য যেমন বেড়েছে, একে ঘিরে জটিলতা এবং আর্থিক অপরাধও বাড়ছে। যা এখন ব্যাংক খাতের বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যাংক কর্মীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।
পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হেলাল আহমেদ চৌধুরী বলেন, এলসি গ্যারান্টি ও ফি কমানোর জন্য বাংলাদেশকে ভিয়েনা কনভেনশনের সদস্য হওয়া উচিত। কেননা, আমাদের বেশিরভাগ রফতানি হয় ইউরোপ ও আমেরিকাতে। ভিয়েনা কনভেনশনের সদস্য হলে এসব ফি কমবে এবং এলসির গ্যারান্টি নিশ্চিত হবে। কারণ, বিশ্বের ৮৯টি দেশ ভিয়েনা কনভেনশনের সদস্য।
বিআইবিএমের চেয়ার প্রফেসর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. বরকত-এ-খোদা বলেন, অর্থ পাচার বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেও অর্থ পাচার ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশকেও অর্থ পাচারের বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে অর্থ পাচার কমিয়ে আনতে হবে। তিনি বলেন, টাকা পাচার ঠেকাতে আইনকানুন এবং বিধির কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু অভাব শুধুই সততা। এ কারণে বড় অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
বিআইবিএমর কর্মশালাটি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে একইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম অফিস থেকে অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম অফিসের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ হুমায়ূন কবিরসহ অন্যরা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০