অনাথ শিশুর মতো যার জীবনখানি নিস্তরঙ্গে নিথর হতে পারতো নিযুত জীবনের নিঠুর নিয়তি পাশে তিনিছিলেন হৃৎস্পন্দনের খোরাক। দেশের জন্য লড়েছেন। শূন্য জমিনে গড়েছেন ব্যবসায় কাঠামো। জীবনের সব অর্জন লিখে দিয়েছেন মানুষের নামে। তিনিই দেশের সবচেয়ে সফল ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’-এর জনক রণদা প্রসাদ সাহা। নারীশিক্ষা ও চিকিৎসায় নারী-পুরুষ কিংবা ধনী-গরিবের ভেদ ভেঙেছেন। তার জীবনেই রয়েছে সসীমকে ডিঙিয়ে অসীমে শক্তি সঞ্চারের কথামালা। এ জীবন ও কেতন যেন রোমাঞ্চিত হৃদয়েরই উদ্দীপ্ত প্রেরণা। পর্ব-২০
মিজানুর রহমান শেলী: চিন্তা আর অনুভূতি বাস্তবতার চেয়ে শক্তিধর। হƒদয়ের দাবিতে মৃণয় থেকে চিন্ময় অবধি জয় করা যায়। বৈষয়িক কৌশল যখন বাস্তবতার নিপীড়িত নিয়তির নিদাঘ যাতনা মুছে দিতে ব্যর্থ হয়, তখন অনুভূতি আর চিন্তার বিশালতা মানুষকে আকাশ-পাতাল জয়ের অজেয় শক্তি জোগায়। ধুন্ধুমার এই রোমাঞ্চকর জীবনের শুরু হয় কারও বা আলস্যে, কারও বা সমাজ-সংসারের অপমান, অবমাননায়। বাড়ি ছাড়া হওয়ার পর রণদার চিন্তা অনুভ‚তিতে এক দারুণ পরিবর্তন আসে। কষ্ট-যাতনা যখন তিনি সইতে শিখলেন, কষ্টের মাঝেও বেঁচে থাকা যায় এই বোধ জন্মালো, নিজের হারানোর যখন কিছু নেই, তখন জীবনটা যত দিন আছে তত দিন প্রগতি বা উন্নতির পথেই হাঁটতে হবে। সে পথে বাধা-বিপত্তি আর মৃত্যু আশঙ্কাকে তোয়াক্কা করার কিছু নেই। জীবনটা বাজিকরের বাজির মতো কিছু একটা না হলেও অনিশ্চিত। এই অনিশ্চয়তার আর বিপদের আশঙ্কা যে কোনো পরিবেশ পরিস্থিতিতেই মানুষকে বরণ করতে হয়। তাই তিনি ভয় আর ক্ষুধার ঊর্ধ্বে প্রগতি, মানবতা আর মহৎ কাজকেই প্রাধান্য দিলেন। এ অনুভ‚তিগুলো বয়স, শিক্ষা আর পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ভিন্ন হতে পারে। চৌদ্দ বছর বয়সী রণদার মনে এই বোধ সুসঙ্গত বা পরিপূর্ণ পরিগঠিত হয়েছিল, তা বলা যায় না। তবে শুরুটা হয়েছিল কলকাতার সংগ্রামী জীবন থেকেই। পরিণত হয়েছেন জীবনের আরও দূর সংগ্রামে।
এই চৌদ্দ বছর বয়সে রণদার পত্রিকা বিক্রির কাজটা ছিল আহার মেটানোর তাড়া অতিক্রান্ত সুকুমার বৃত্তির চর্চাকাল। বিশ শতকের গোড়ায় বাংলার ‘নবজাগরণ’র চেতনাকালে পত্রপত্রিকা আর জ্ঞানগরিমার কদরও ছিল সবার ঊর্ধ্বে। রেললাইনে বা ফুটপাতে ঘুমিয়েও পত্রিকার পাঠক ও সংবাদকর্মীর সাহচর্য তিনি পান। খবরের কাগজ পড়া এবং জ্ঞান লাভের সুযোগও তিনি পেয়েছিলেন। নবজাগরণের ওই যুগে কলাম লেখকদের লেখায়ও প্রগতি, উন্নতি, মানবতা আর সুকুমারবৃত্তির জয়গান বিধৃত হতো। নিউ ইন্ডিয়া, অরবিন্দ ঘোষের বন্দে মাতরম, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের সন্ধ্যা ও যুগান্তরের মতো পত্রপত্রিকা স্বরাজের জন্য সংগ্রামের ডাক দিচ্ছিল। বরিশালের ‘বরিশাল হিতৈষী’ পত্রিকার নাম বাদ দেওয়া যায় না। এসব শিক্ষা আর চেতনা রণদাও ধীরে ধীরে রপ্ত করতে থাকেন। কাজেকর্মেও তাই তা ফুটে উঠত।
একবার রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রণদা খবরের কাগজ বিক্রি করছেন। অপেক্ষমাণ যাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড়। হকারদের হৈচৈ। শোরগোলের উš§াদনায় চারদিক যেন বিক্ষিপ্ত, অগঠিত। এসব ছাপিয়ে রেলগাড়ি তার ইঞ্জিনের মেটালিক শব্দ আর ভেঁপু বাজাতে বাজাতে স্টেশনে ঢুকছে। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। ওঠার যাত্রীরা বগি ধরা এবং ভালো সিট পাওয়ার সন্ধানে যেমন অন্য সবকিছু ভুলে গেছে। ঠিক নামার যাত্রীরাও। আর অন্যান্য যারা আছেন তারা যার যার খোশখেয়াল বা কাজে মত্ত। একটি ভদ্রোচিত ছোট পরিবারও গাড়িতে উঠবেন বলে দাঁড়িয়ে আছেন। স্বামী, স্ত্রী আর তাদের ছোট ফুটফুটে তিন বছরের বাচ্চা। সদ্য হাঁটা শেখা এমন বাচ্চাদের ঠিক কোলে আটকে রাখা দুষ্কর। কত রাজ্যের গল্প আর ছেলেখেলা করেই না এমন শিশুকে আটকে রাখা যায়। কিন্তু ব্যস্ততার এই সময় রেললাইনের প্রশস্ত প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে মা তার বচ্চাটিকে ছেড়ে দিয়েছেন। খানিক বাদে মা তার বাচ্চাটিকে আর খুঁজে পান না। এদিকে-সেদিকে তাকিয়ে অস্থির কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ কান্নার চিৎকার ধ্বনি। দেখতে পান প্ল্যাটফর্ম থেকে শিশুটি রেললাইনে পড়ে গেছে। শিশুটির মা-বাবা দৌড়ে গিয়েও সাধ্য আর সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। বাচ্চাটিকে তুলবেন। অগত্য কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন তারা। অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অনেকের কাছে সাহায্য চাচ্ছেন। ভেবে পাচ্ছেন না কী করার, কিভাবে কী করবেন। কেউ সাহস করে এগিয়েও আসছেন না।
দেখা মাত্রই, রণদা ক্ষিপ্র বেগে ছুটে এলেন। শিশুটাকে উদ্ধার করবেন রণদা। লাফ দিয়ে রেললাইনে নামার আগে হাতের সব পত্রিকা তাড়াহুড়ো করে মাটিতে রাখতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তা ছড়িয়ে পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। এখন কী করবেন রণদা! এটা তো তার সারাদিনের পুঁজি ও রুজি। আবার রেলগাড়িও ঠিক চলে এসেছে। বাচ্চাটিকে পিষে ফেলে গাড়িটির অতিক্রম করতে কয়েক পলকই বাকি আছে। এই পত্রিকার ছোট ফেরি ব্যবসার পুঁজি আর সারা দিনের রুজি আগলে ধরবেন নাকি একটি প্রাণ! না অতো কিছু ভাবার পাত্র রণদা নয়। সেদিকে ভ্রƒক্ষেপ করলেন না রণদা। ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ঠিক ট্রেনের মুখ থেকে বাচ্চাটাকে কুড়িয়ে আনলেন কোলে জড়িয়ে। মুহূর্তে রেলগাড়ির সারিবদ্ধ লোহার চাকাগুলো ফিশপ্লেটের মুখের ওপর আঘাত করে করে কাঠের সিøপারকে শাসিয়ে গ্রান্ডি ড্যান্সারের ধোয়া তুলে ধেয়ে চলল সামনে।
মা তার শিশুটিকে পেয়ে আপ্লুত, তার চেয়েও বেশি কৃতজ্ঞ। ভাষাহীন। বাবারও একই দশা। কোলের শিশুটি পড়ে গেলে যতটা বিমূঢ় হয়েছিলেন, এই কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আরও বেশি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। খানিক বাদেই বাবার মুখে ঋণ পরিশোধের ব্যর্থ চেষ্টা ফুটে উঠল থতমত চাহনিতে। চারদিকে লোকেরা যারা হা-হুতাশ করছিলে দূর থেকে, এখন তারা জটলা পাকিয়েছে। শিশুটি ভয়ে কাঁদছে; তাকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন মা। শিশুটিকে কোলে জড়িয়ে মা একবার শিশুটির বাবার দিকে, আরেকবার রণদার দিকে তাকিয়ে আছে। রণদা তখন এই জটলা ছেড়ে কৃতজ্ঞতার বন্ধন অতিক্রম করেত চাইছে। মুখ লুকিয়ে ভুলতে চাইছে, যা সে করেছে। যে আদর ছিন্ন করে অনাদরের গøানি ভুলে রণদা সাহাপাড়া ছেড়েছে, সেই মিছে মায়া তার সহে না। কৃত্তিমতা আর বেশাতিকে পাশ কাটিয়ে সুগঠিত হƒদয় গঠনেই তার দৃষ্টি। করুণা, স্নেহ আর কৃতজ্ঞতা এখন এই অনাবাদি রণার হƒদয়কে বিকর্ষণের জ্বালায় অস্পৃশ্য-অচ্ছুত করে তোলে।
কিন্তু শিশুটির বাবা রণদার এই মহৎ কাজের পুরস্কার দিয়ে ধন্য হতে চাইলেন। বিনয়ের সঙ্গে রণদা তা নিতে অস্বীকার করলেন। সাধারণ ভদ্রতা ভেবে হয়তো রণদা টাকা নিতে চাচ্ছেন না এমনই ধারণা হলো ভদ্রলোকটির। তাই তিনি বারবার রণদার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনুরোধ করছেন টাকাটি রাখো। পাশের জটলা থেকেও লোকেরা পুরস্কার গ্রহণ করতে পরামর্শ দিচ্ছে রণদাকে। কিন্তু রণদার হƒদয় পীড়ন বেড়েই চলেছে। তর সইছে না আর এই স্নেহমাখা বচন বর্ষণ! রণদা তো অনড়। দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়ে দিলেন, টাকার জন্য তো আমি ওকে তুলে আনিনি।
ছাত্র ভাইদের সাহচর্য, পত্রিকার মহতী বাণী আর ভারতজুড়ে ‘নবচেতনা’য় একটু একটু করে ঋদ্ধ রণদা তখন স্বার্থের চেয়ে সতত মানবতাকেই চিনতে শিখেছে। তাই রণদাকে শিশুটির বাবা কোনোভাবেই পুরস্কার নিতে রাজি করাতে পারছে না। যে পুরস্কার শিশুটির বাবার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপায়-উপলক্ষ মনে হচ্ছে। সেটাই রণদার কাছে পারিশ্রমিক তুল্য অথবা করুণার।
কেননা, শিশুটির বাবা তাকে এ বলেও পুরস্কার নিতে অনুরোধ করছে যে, তোমার পত্রিকাগুলো তো নষ্ট হয়ে গেছে। তুমি আজ কী খাবে? তুমি এটা রাখো। কিছু খেয়ে নিও। ছোটবেলা থেকে যে রণার খেয়ে না খেয়ে কেটেছে, তার তো আর খাওয়ার দায় থাকার কথা না! রণদা তাই সুগঠিত কণ্ঠে জানিয়ে দেন, টাকার জন্য নয়। বরং শিশুটি মারা যেত, তাই আমি তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছি। আর একদিন অনাহারে থাকলে মানুষ মরে না। আমার কিছু হবে না।
অগত্যা শিশুটির বাবা কোনো উপায়ান্তর না দেখে রণদার জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করলেন। আশীর্বাদ জানালেন। রণদা ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এলেন। হারিয়ে গেলেন সাধারণের দলে। যেমন ভোরের শুকতারা আঁধার ছিঁড়ে সকালের শুভবার্তা দিয়ে মুখ লুকিয়ে নেয়, কোনো প্রশংসার এক দণ্ড প্রহর গোনে না। সেভাবেই রণদা ভুলে গেলেন, জীবনের আঁকেবাঁকে কলকাতার গলি পথে, শিয়ালদহের যে প্রান্তরে অনাথ রণদার পিঞ্জিরার মাঝে নিদাঘ তিয়াসা ক্ষণে ক্ষণে রুষে উঠত, ক্ষণে ক্ষণে মানবচেতনার আওয়াজ ধ্বনিত হতো। সে আওয়াজের সঙ্গে অবশ্য জ্যাঁ জ্যাঁক রুশোর রোমান্টিসিজমের আক্ষরিক ধারণা ছিল না। জেমস টমসনের ‘দ্য সিজন’ কাব্যগ্রন্থও তার পড়া হয়নি। কিংবা ব্রিটিশ উপন্যাসিক রিচার্ডসনের ‘পামেলা’ বা ‘ক্লারিসা’ উপন্যাসও তার পড়া হয়নি। আবার অর্থনৈতিক বাস্তবতা, সামাজিক সংসর্গ, রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার যুগে নির্মম বাস্তবতা দিয়ে নির্মমতা নাশের পরিবর্তে রোমান্টিসিজমের ধারণাও তার একাডেমিক অবয়বে শেখা হয়নি। তবে অনুভ‚তি আর আবেগ দিয়ে সত্যকে প্রভাবিত করা এবং সত্যকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করার বোধ তার জেগেছিল।
লেখক: গবেষক, শেয়ার বিজ
mshelleyjuÑgmail.com
Add Comment