পথশিশুদের পুনর্বাসন

ফারজানা ইয়াসমিন: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদেশের শিশুদের কল্যাণের কথা চিন্তা করে ১৯৭৪ সালে ‘শিশু আইন, ১৯৭৪’ প্রণয়ন করেছিলেন। এ আইনটিই বাংলাদেশের শিশুদের কল্যাণের জন্য পথনির্দেশ হিসেবে কাজে লাগছে। একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মহান নেতা বঙ্গবন্ধু ’৭৪ সালে যা চিন্তা করেছিলেন, তার গুরুত্ব সমসাময়িক বিশ্বের অনেক দেশ তখনও বুঝতে পারেনি। এমনকি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা পথশিশুদের পুনর্বাসনে তার রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও ব্যক্তিগত চিন্তার বিষয়ে ১৯৮৮ সালে ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’য় একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। জাতির পিতা ১৯৭৪ সালে যে কাজ করেছিলেন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ১৯৮৮ সালে যে ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়েছিল, তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ (Conversation on the rights of the child, CRC)  গ্রহণ করে। এখানেই জাতির পিতা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এরই ধারাবাহিকতায় শিশু অধিকার, শিশু শ্রম নিরসন, বাল্যবিবাহ রোধ, শিশু আইন-২০১৩ সরকার অনুমোদন করেছে।

বাংলাদেশ এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্তরণ, বিশ্বে বাংলাদেশের জন্য এক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। পাশাপাশি অনেক চ্যালেঞ্জেরও মুখোমুখি দাঁড় করিয়াছে। আমাদের মাথাপিছু আয়, জিডিপির আকার, জাতীয় বাজেটের বিস্তৃতি এবং উন্নয়নসূচক জাতি হিসেবে আমাদের আত্মমর্যাদাকে সমুন্নত করেছে। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে না পারলে আমাদের এ অর্জন ব্যাহত হবে। তাই এখনই সময় জাতির পিতা যে নির্দেশনা ১৯৭৪ সালে দিয়েছিলেন তার সেই নির্দেশনার আলোকে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূলস্রোতে ফিরিয়ে এনে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। সমাজের পিছিয়ে পড়া পথশিশুদের পুনর্বাসন কাজকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এগিয়ে নেয়া শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয়, আমাদের নৈতিক দায়িত্বও বটে। পথশিশুরা বিরূপ পরিবেশে বেড়ে ওঠে। তাদের সমাজের সুস্থ ও অনুকূল পরিবেশের মধ্যে আনতে পারলে তাদের সামগ্রিক উত্তরণ ত্বরান্বিত হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০০২-২০০৩ সালে সর্বশেষ পথশিশুদের নিয়ে বেইজলাইন সার্ভে করেছিল। সেখানে পথশিশুদের আর্থসামাজিক বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছিল। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) পথশিশুদের নিয়ে এক সমীক্ষা করে। উভয় জরিপের প্রক্ষেপণে ২০২৪ সালে দেশের পথশিশুর সংখ্যা ১৬ লাখ অতিক্রম করতে পারে মর্মে ধারণা করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন তথ্য ও গবেষণা মতে, বর্তমানে দেশে পথশিশুর সংখ্যা কমবেশি ১১ লাখ মনে করা হয়। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পথশিশুদের সামগ্রিক অবস্থা জানার জন্য একটি জরিপ প্রয়োজন। বাংলাদেশে আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় সুপরিকল্পিত কর্মপন্থায় অগ্রসর হলে সবার সহযোগিতায় দুই মিলিয়নেরও কম সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের পুনর্বাসন করা খুব কঠিন কাজ বলে মনে হয় না।

বাংলাদেশে পথশিশুদের নিয়ে ১৭টি এনজিও নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ছাড়া বেশকিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের নিজ অর্থায়নে এবং উদ্যোগে পথশিশুদের কল্যাণে কাজ করছে। এসব সংগঠন নিত্য ঘাত-প্রতিঘাতে বেড়ে ওঠা পথশিশুদের অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগ্রত করে তাদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নিঃসন্দেহে এটা একটি মহৎকর্ম। এনজিও ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের চলমান কার্যক্রম যাতে আরও ফলপ্রসূ হয় অর্থাৎ আরও অধিকসংখ্যক পথশিশুকে এ কার্যক্রমের আওতায় আনা যায়, সে জন্য তাদের সামগ্রিক কর্মসূচির মধ্যে সুসমন্বয় করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের নেতৃত্বে বুয়েটের একদল মেধাবী ছাত্র একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ইতোমধ্যে তৈরি করেছে, যেখানে ব্যবহƒত ফান্ড এবং উপকারভোগীদের ব্যবস্থাপনা একটি ইন্টারফেসের মাধ্যমে পরিচালনা করার ব্যবস্থা রয়েছে।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, পথশিশুদের প্রায় অর্ধেক অশ্লীল কথার শিকার হয়। শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয় ২০ শতাংশ। ১৪.৫ শতাংশ পথশিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়। আর মেয়ে পথশিশুদের ৪৬ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহান্সমেন্ট প্রোগ্রামের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ৪৪ শতাংশ পথশিশু মাদকাসক্ত, ৪১ শতাংশ শিশুর ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ শিশু গোসল করতে পারে না, ৩৫ শতাংশ শিশু খোলা জায়গায় মল ত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ শিশু অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই, ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থ হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারে না। পথশিশুদের ২৫-৩০ ভাগ মেয়েশিশু। তারাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে। ঢাকাসহ সারাদেশে পথশিশুদের নিয়ে যেসব সংগঠন কাজ করে, তাদের কেউ পোশাক দেয়, কেউ খাবার দেয়, কেউ শিক্ষা দেয়, কেউবা বিনোদনের ব্যবস্থা করে। কিন্তু দিনশেষে এসব সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুরা পথেই রাত কাটায়। তাদের থাকার কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা হয় না। সরকার ‘পথশিশুদের উন্নয়ন কার্যক্রম’ নামে একটি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সেখানে শিশুদের থাকা-খাওয়া এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে। পথশিশুদের জন্য সরকার শেল্টার হোম করছে। কিন্তু পথশিশুরা সেখানে যেতে চায় না। পথশিশুরা স্বাধীনভাবে চলাফেরায় অভ্যস্ত। তারা তাদের ভালো-মন্দ নিজের মতো করে বোঝে। এসব শেল্টার হোমের নিয়মকানুন তারা বুঝতে চায় না। তাদের কাছে এগুলো বন্দিশালার মতো মনে হয়। এসব শেল্টার হোমকে পথশিশুদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে তাদের মানসিক পরিবর্তন করতে হবে। তাদের চাহিদা পূরণের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এ শেল্টার হোমগুলো শিশুবান্ধব করতে হবে।

মানুষের মানবতা এবং মনুষ্যত্ব দিন দিন হ্রাস পাওয়ার কারণে পথশিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। একশ্রেণির দরিদ্র মানুষ অপরিকল্পিতভাবে সন্তান জন্ম দিয়ে একটা নির্দিষ্ট সময় পর তাদের পরিত্যাগ করে চলে যায়। এভাবেই বাড়তে থাকে অবহেলিত পথশিশু। এ ছাড়া পিতামাতার অকালে মৃত্যু, মা-বাবার সেপারেশন, পরিবারের অবহেলা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়া, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, শিশু নির্যাতন, নগরায়ণ, শিশুর মানসিক ভারসাম্যহীনতা, যৌন দৃষ্টিভঙ্গি বা লিঙ্গ পরিচয় অন্যতম। পথশিশুদের পুনর্বাসনে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, শিশুদের থাকার স্থায়ী কোনো অবকাঠামো নেই। বর্তমানে উপকারভোগী পথশিশুদের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভাড়া বাড়িতে রাখা হয়। ঠিকানাবিহীন ও ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের পুনর্বাসনে জটিলতা, শিশুদের দ্রুত উদ্ধার, তাদের চিকিৎসা, শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণে যাতায়াতের জন্য যানবাহনের নেই কোনো ব্যবস্থা। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে বিশেষ করে দক্ষিণ অঞ্চলের ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও বরিশাল জেলাসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়, নদীভাঙন এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলার শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এসব এলাকায় মাঠ পরিদর্শনের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের চিহ্নিত করে তাদের ট্রানজিট হোমে নিরাপদে রাখতে পুনর্বাসন করা যেতে পারে। ঢাকা শহরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিশুদের অনিরাপদ আগমন বন্ধে তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন স্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করা দরকার। সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় শিশুদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তাদের চলমান কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করতে হবে।

বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮-এর লক্ষ্য ও পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছেÑপথশিশুদের পুনর্বাসন ও নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল শিশুদের জন্য শিশুসদন প্রতিষ্ঠা এবং বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা উন্নত ও প্রসারিত করা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা ‘একটি শিশুও রাস্তায় থাকবে না, রাস্তায় ঘুমাবে না’। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই সচেতন। পথশিশুদের পুনর্বাসনের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে আগামী বছরের জুনের মধ্যে প্রত্যাশিত অগ্রগতি অর্জনে সচেষ্ট হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রেখে যাওয়া স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বর্তমানে উন্নীত হয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছে বাংলাদেশ। ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার পথে ধাবমান আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উন্নত বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে জীবনযাপন করবে, থাকবে না সেখানে সুবিধাবঞ্চিত কোনো গোষ্ঠী। এটাই আমাদের সবার প্রত্যাশা।

পিআইডি নিবন্ধন

বিষয় ➧

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০