কুদরতে খোদা সবুজ, কুষ্টিয়া: কার্তিকের শুরুতেই কুষ্টিয়াজুড়ে হালকা শীতের আমেজ বইতে শুরু করেছে। খুব সকালে ঘাসের ডগায় শিশিরবিন্দু জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। ঋতুচক্রের পালাবদলে পুরোপুরি শীত না এলেও কুষ্টিয়ায় আসতে শুরু করেছে শীতের পরিযায়ী পাখি। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার পদ্মা নদীর চরাঞ্চল এখন পরিযায়ী পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখর। নদীর এপার থেকে ওপার উড়ে চলা পাখির নয়নাভিরাম দৃশ্য মুগ্ধ করার মতো।
পদ্মার চরে পরিযায়ী এসব পাখির খাবারের সন্ধান, খুনসুটি, বিশ্রাম আর ওড়াউড়ির এক নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে ভিড় করছেন দর্শনার্থীরা। পাখিদের দৃষ্টিনন্দন ছবি তুলতে চিত্রগ্রাহকেরাও আসছেন নানা স্থান থেকে। এতে বাড়তি রোজগার বেড়েছে নদীপারের মাঝিদের।
এদিকে এসব পাখির নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছে বন বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসন। বন বিভাগ বলছে, পরিবেশগত কারণ ও খাবারের সন্ধানে শীতের শুরু থেকে শেষ সময় পর্যন্ত পরিযায়ী পাখিদের বিচরণ বাড়ে। শীতের শুরুতে নদীর শান্ত বুকে জেগে ওঠা চরে ঝাঁকবেঁধে আকাশে ডানা মিলছে এসব ভিনদেশি পাখি। রং-বেরঙের এসব পাখিকে ডাকা হয় অতিথি পাখি নামে। অতিথি পাখি হলেও এরা হিমালয়ের পাদদেশ আর রাশিয়ার বিভিন্ন এলাকার হিমশীতল আবহাওয়া থেকে রক্ষা পেতে ঝাঁকে ঝাঁকে পাড়ি জমায় বাংলাদেশে।

দৌলতপুর উপজেলার মরিচা, ফিলিপনগর, চিলমারী ও রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের পদ্মার চরে দেখা মিলছে কালোমাথা কাস্তেচরা, খোল শামুক, আবাবিল, লিটিল টার্ন, কালা পাখি ঠেঙ্গিসহ নানা প্রজাতির পাখি। ছয় লাখের বেশি জনসংখ্যার এই উপজেলায় কোনো বিনোদন কেন্দ্র না থাকায় প্রতিদিন পদ্মাপারে ভিড় জমাচ্ছেন দর্শনার্থী ও প্রকৃতিপ্রেমীরা।
পদ্মাপারে ঘুরতে আসা রাকিবুল ইসলাম নামের এক যুবক জানান, শীতের শুরুতেই আমাদের এই পদ্মার চরে অতিথি পাখিগুলো আসে। এগুলো দেখতে খুবই ভালো লাগে। নদীর পারে বেড়াতে এসে পাখিগুলো দেখে নৌকায় পদ্মার চরে গিয়েছিলাম তাদের সঙ্গে মিশে যেতে।
নাইমুর রহমান নামের আরেকজন বলেন, পদ্মার চরে আসা অতিথি পাখিগুলো দেখে বেশ ভালো লাগছে। এটা এক অন্য রকম মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।
ঘুরতে আশা দর্শনার্থীদের বাড়তি বিনোদন দিতে নদী পারাপারে বেড়েছে মাঝিদের ব্যস্ততাও। মাঝি ও নৌকার মালিকেরা বলেছেন, নদীপারের সৌন্দর্যবর্ধন করা হলে আরও বেশি দর্শনার্থী আসবে।
সাগর নামের স্থানীয় এক মাঝি জানান, প্রতিদিন বিকাল হলেই নদীর পারে বেড়াতে আসেন বিভিন্ন এলাকার মানুষ। তারা নৌকায় চড়ে পদ্মার চরসহ নদীতে ঘুরে বেড়ান। এতে মাঝিদের রোজগার ভালো হয়।
কথা হয় স্থানীয় চিত্রগ্রাহক তন্ময় তাহসান সবুজের সঙ্গে। তিনি জানান, তারা প্রায় পদ্মার চরে দলবেঁধে এসব অতিথি পাখিদের ছবি তোলেন শখের বসে। ছবিগুলো শখের বসে ওঠালেও পাখিদের খুনসুটি বেশ উপভোগ করেন তারা।
তবে অভিযোগ আছে চরে পাখিদের আগমনের সঙ্গে বাড়ে শিকারিদের আনাগোনা।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়া বার্ড ক্লাবের সভাপতি ও পাখি গবেষক এসআই সোহেল বলেন, অতিথি পাখি শিকার বন্ধ না হলে জীববৈচিত্র্যের মান নষ্টের পাশাপাশি কমে আসবে অতিথি পাখিদের সংখ্যা। এসব পাখি আমাদের সম্পদ। এগুলো রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব, যা আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে। স্থানীয়দের সচেতনতার পাশাপাশি দরকার প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা।
এদিকে বন বিভাগ বলছেন, প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে পরিবেশগত উন্নতি ও খাবার নিশ্চিত হওয়ায় এ সময়ে পদ্মার চরে বাড়ে অতিথি পাখিদের বিচরণ। সেইসঙ্গে এসব পাখির নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, উপজেলা বনবিভাগসহ প্রশাসন।
এ বিষয়ে উপজেলা বন কর্মকর্তা আবু বকর জানান, বিভিন্ন ধরনের গাছপালা বাড়ায় পাখির খাবার ও বসবাসের জায়গা বেড়েছে। ফলে বসবাসযোগ্য হওয়ায় পাখি পদ্মার চরে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে।
তিনি আরও জানান, এ ছাড়া বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য তৈরির জন্য ফিলিপনগর ইউনিয়নের বাহিরমাদি মৌজা এলাকায় জমির প্রস্তাব দেয়া আছে। অনুমতি পেলে আমরা নতুন করে কার্যক্রম শুরু করব।
বন বিভাগের দেয়া তথ্যমতে, এ বছর উপজেলার পদ্মার চরে মদনটাক, বালিহাঁসসহ হিমালয়ের শকুনের দেখা মিলেছে। এ ছাড়া চরের বিভিন্ন স্থানে স্থায়ী বাসা বেঁধেছে শত শত পরিযায়ী পাখি।
এ বিষয়ে দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ওবায়দুল্লাহ জানান, এসব পাখি আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। পাখিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। সেই সঙ্গে পাখি শিকার হলে প্রশাসনকে জানাতে ইউপি চেয়ারম্যানদের নির্দেশ দেয়া আছে। একটি পাখিও যেন শিকার না হয়, সে বিষয়ে আমরা তৎপর আছি।