পদ্মাসেতুর বামতীর সংরক্ষণ প্রকল্পে ভাঙনে ১০ বাড়ি বিলীন

শেখ মোহাম্মদ রতন, মুন্সীগঞ্জ: টানা বৃষ্টিতে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে হঠাৎই আগ্রাসী রূপে পদ্মা। এতে গেল দুই দিনে প্রায় ১০টির বেশি বসতবাড়ি গাছপালাসহ নদীতে বিলীন হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। এতে ভাঙনঝুঁকিতে রয়েছে নদী-তীরবর্তী অন্তত শতাধিক পরিবার।

সোমবার ও মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরজমিনে ঘুরে দেখা যায়, প্রবল স্রোতে কারণে গত মধ্যরাত থেকে হঠাৎই আকস্মিক ভাঙন দেখা দিয়েছে পদ্মা সেতুর বাম তীর সংরক্ষণ প্রকল্প এলাকায়। এতে ভিটে মাটি হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের বড় নওপাড়া এলাকার ৩নং ওয়ার্ডের ৮ থেকে ১০টি পরিবারের শতাধিক মানুষের।

স্থানীয়দের অভিযোগ প্রকল্পের কাজে ধীরগতির কারণে কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙনের ঝুঁকি বেড়েছে নদী-তীরবর্তী গ্রামগুলোতে। অন্যদিকে দীর্ঘদিনের সাজানো সংসার চোখের সামনে মুহূর্তেই নদীতে বিলীন হতে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন অনেকে। এতে আতঙ্কে নিজেদের উদ্যোগে ঘরবাড়ি ভেঙে সরিয়ে নিয়েছেন অন্তত ২০টি পরিবার।

আশ্রয়হীন এসব মানুষের দাবি দ্রুত সরকারিভাবে পুনর্বাসন করার। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষের অভিযোগ পদ্মায় অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন ও নির্দেশনা অমান্য করে অবৈধ বাল্কহেড চলাচলের কারণে গত বেশ কয়েক বছরের তুলনায় ভাঙনের ঝুঁকি বেড়েছে কয়েকগুণ বেশি। তবে ভাঙন ঠেকাতে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলার কার্যক্রম শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। টানা দুই দিনে ভাঙন ঠেকাতে ফেলা হয়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশি জিও ব্যাগ তবে নদীতে গভীরতা বেশি থাকায় ব্যাহত হচ্ছে কার্যক্রম।

ক্ষতিগ্রস্ত শ্রাবন্তী রাজবংশী বলেন, ‘২৫টি বছর ধরে সাজানো সংসার গুছিয়েছি মুহূর্তেই চোখের সামনে নদীতে বিলীন হয়ে গেল সব কিছু কিছুই বের করে রাখতে পারলাম না, স্বামী আর সন্তানদের নিয়ে এখন কোথায় যাব, কে আশ্রয় দেবে আমাদের, সরকার যদি আমাদের পুনর্বাসন করে, আর্থিক সহযোগিতা দেয় এই মুহূর্তে হয়তো বাঁচতে পারব। তা না হলে না খেতে পেয়ে মরা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমাদের।’

ময়না বারই নামে আরেক গৃহবধূ বলেন, ‘বিয়ের পর থেকে পদ্মা পাড়ে শ্বশুরবাড়িতে নতুন সংসার গুছিয়েছি, মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে মাথা গোঁজার থাইটুকু হারালাম, এখন বাঁচব কীভাবে, পদ্মার ভাঙন সব কেড়ে নিয়েছে আমাদের, দীর্ঘদিন ধরে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে, যদি বর্ষা মৌসুমের আগেই দ্রুতগতিতে বালুভর্তি জিও ব্যাগগুলো সময়মতো ফেলত তাহলে এভাবে নদীভাঙনের শিকার হতে হতো না আমাদের বেশ কয়েকটি পরিবারের।’

অপু দাস নামের ভাঙনকবলিত আরেক ক্ষতিগ্রস্ত বলেন, ‘২৪ লাখ টাকা খরচ করে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকার জন্য নতুন বিল্ডিংটি উঠিয়েছি মাত্র। ভাগ্য আমাদের সহায় হয়নি, পদ্মার ভাঙন পথে বসিয়ে দিল আমাদের, দিনের পর দিন বলেছি বারবার মানুষের দ্বারস্থ হয়েছি, স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের বলেছি পদ্মায় বালুকাটা বন্ধ করতে ব্যবস্থা নেন কেউ কথা শুনেনি, অবশেষে করুণ পরিণতি বয়ে এলো জীবনে।’

ভাঙনের শিকার ইকবাল মৃধা বলেন, ‘নদীশাসনের সময়ে এভাবে ঘর বিলীন হবে ভাবতে পারিনি। আমার তিনটি ঘরের মধ্যে একটি বিলীন হয়েছে।’

পানি উন্নয়ন বোর্ডের মুন্সীগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী জানান, পদ্মা সেতুর ভাটিতে বাম তীর রক্ষায় প্রায় ৪৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে রক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজ চলছে প্রায় দুই বছর ধরে। স্রোতে হঠাৎ করেই নদীর তলদেশ থেকে মাটি ও জিওব্যাগ সরে গিয়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ৪৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতুর বাম তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায়, ২০২১ সালের মে মাসে শুরু হয় প্রায় ১৪ কিলোমিটার এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের কাজ, যা শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে। এর মধ্যে ৯ দশমিক ১০ কিলোমিটার এলাকায় নির্মাণ হবে স্থায়ীবাঁধ। আর ৪ দশমিক ৬২ কিলোমিটার এলাকায় নেয়া হবে ভাঙন প্রতিরোধক অস্থায়ী ব্যবস্থা।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ভাঙতে ভাঙতে এ ইউনিয়নটি প্রতি বছর ছোট হচ্ছে। ভাঙন রোধে সরকার ৫০০ কোটি টাকার যে প্রকল্প নিয়েছে, এখানে বড়নওপাড়াও রয়েছে। ঠিকঠাক মতোই ভাঙন প্রতিরোধের কাজ চলছিল। মাঝখানে এক মাসের মতো এ প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল। যদি বন্ধ না থাকত, তাহলে ভাঙন নাও হতে পারত।

অন্যদিকে বালু উত্তোলনসহ তীরঘেঁষে অবৈধ বাল্কহেড চলাচল বন্ধে শিগগিরই স্থায়ী পদক্ষেপ নেয়া হবে বলছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ভাঙনের খবর শুনে চারবার ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছি, সেখানকার ভাঙন নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে পাঁচ হাজার বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। ভাঙন নিয়ন্ত্রণের জন্য চেষ্টা চলছে। ভাঙন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত জিও ব্যাগ ফেলা হবে। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্তদের শিগগিরই সরকারি সহযোগিতায় পুনর্বাসনে উদ্যোগ নেয়া হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০