Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 5:00 pm

পদ্মা ব্যাংকের পর্ষদে ফিরতে চান বাবুল চিশতী!

উদ্যোক্তা পরিচালক হয়ে মাহবুবুল হক চিশতী দি ফারমার্স ব্যাংকে (বর্তমান পদ্মা ব্যাংক) কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণে অনিয়ম করেছেন। বেপরোয়াভাবে স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে ও ভাইকে ঋণ দিয়েছেন ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে। এসব ঋণের অর্থের সুবিধাভোগী তিনি নিজেই। ঋণের অর্থে ফারমার্স ব্যাংকের শেয়ার কিনেছেন নিজ নামে। সাধারণ গ্রাহকের অর্থ লুট করে গড়েছেন অর্থবিত্তের বিশাল সাম্রাজ্য। এ নিয়ে শেয়ার বিজের ধারাবাহিকের শেষ পর্ব

শেখ আবু তালেব: ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমান পদ্মা ব্যাংক) পর্ষদের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগের পরও দুর্নীতি থামাননি মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী। তার স্বাক্ষরের সুপারিশে ৮৫ ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয় ব্যাংকে। এজন্য নামকাওয়াস্তে পরীক্ষা নিলেও উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়নি কারও। ব্যাংকের শেয়ার দেওয়ার কথা বলে টাকা নিলেও শেয়ার দেননি। এছাড়া ঋণ ও কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে সরিয়ে নিয়েছেন কয়েক হাজার কোটি টাকা। সেই বাবুল চিশতী এবার পদ্মা ব্যাংকে ফিরতে চাচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে এমন তথ্য।

জানা গেছে, ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে গড়ে তোলা সম্পদের তালিকা করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতোমধ্যে গ্রামের বাড়ি জামালপুরে ২৮ কোটি টাকার সম্পত্তি খুঁজে পেয়েছে, যা গোপন ছিল। এর বাইরে কেলেঙ্কারির অর্থে গড়া কারখানা, কোম্পানি ও ঢাকার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের সন্ধান পেয়েছে দুদক। এসবই করা হয়েছে নিজ নামের পাশাপাশি স্ত্রী, ভাই, সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনদের নামে। অর্থের সুবিধাভোগী ও ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত হওয়ায় বাবুল চিশতীর আত্মীয়-স্বজনদের সম্পত্তিরও খোঁজ নিচ্ছে দুদক।

এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে বাবুল চিশতীসহ তার পরিবার ও আত্মী-স্বজনদের বিরুদ্ধে মোট ১২টি মামলা করেছে দুদক। এর মধ্যে বাবুল চিশতীকে আসামি করা হয়েছে ৯টি মামলায়। এসব মামলায় ক্ষমতার অপব্যবহার, অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। মামলাগুলোর মধ্যে কয়েকটির বিচারকার্য শুরু হয়েছে। চার্জশিট দেওয়া হয়েছে কয়েকটির।

মামলা দায়েরের পর ঋণ কেলেঙ্কারির অর্থ ফেরত পেতে বাবুল চিশতীর স্থাবর-অস্থাবর ও ব্যাংক হিসাবে থাকা এফডিআরের অর্থ জব্দের আবেদন করে দুদক। আবেদন পর্যালোচনা করে বাবুল চিশতীর সব সম্পত্তি ও ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

জানা গেছে, দুদকের অনুসন্ধানে বাবুল চিশতীর নামে ২৮ কোটি ৫৫ লাখ ৬১ হাজার ৫৯০ টাকা, স্ত্রী রোজি চিশতীর ৩৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, শ্যালক মোস্তফা কামালের প্রায় ৮৭ লাখ টাকা, ছেলে রাশেদুল হক চিশতীর ৩২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, ছেলের বউ ফারহানা আহমেদের ১৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা এবং কলেজপড়–য়া মেয়ের নামে ২১ কোটি ২০ লাখ টাকার সম্পদ বেরিয়ে আসে। এসব সম্পদের প্রায় পুরোটাই গোপন করা হয়।

এখানেই শেষ নয়, ফারমার্স ব্যাংকের শেয়ার দেওয়ার কথা বলে বনানীর এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা নিয়েছেন। ডিজি ইনফোটেকের ওই পরিচালক দুদকের কাছে লিখিতভাবে উল্লেখ করেন, ‘পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বনানীর একটি ফ্ল্যাট বিক্রি করে ৫০ লাখ টাকা বাবুল চিশতীকে দিই ব্যাংক চেকের মাধ্যমে। কিন্তু তার বিপরীতে শেয়ার দেননি। পরে একটি চেক দেন, যা আজও ভাঙিয়ে টাকা ওঠানো যায়নি।’

এছাড়া ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালক মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহীম ও শরীফ চৌধুরী এবং শেয়ারহোল্ডার রুমি আক্তারের কাছ থেকে শেয়ার ক্রয় করেন। শেয়ারগুলো কেনা হয় বাবুল চিশতী ও তার ছেলে রাশেদুল হক চিশতীর নামে। ফারমার্স ব্যাংক থেকে ভুয়া কোম্পানির নামে ঋণ নিয়ে শেয়ারগুলো কেনা হয়। এভাবে ব্যাংকের টাকায় নিজের নামে শেয়ার কেনেন তিনি।

গড়ে তুলেছেন সম্পত্তির পাহাড়

ঋণ কেলেঙ্কারির অর্থে ঢাকা ও নিজ জেলা জামালপুরে গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পত্তি। এখন পর্যন্ত দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, বাবুল চিশতীর নামে ফারমার্স ব্যাংকে ৪০ কোটি টাকার উদ্যোক্তা পরিচালকের শেয়ার, রাজধানী মহাখালীর নিউ ডিওএইচএসের ৩০ নম্বর রোডের ৪১৯ নম্বর বাড়িতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, ঢাকার নিকুঞ্জের ২/এ নম্বর রোডের ১৮ নম্বর প্লটে ডুপ্লেক্স বাড়ি, তেজগাঁওয়ের এলেনবাড়ীতে এলাকায় ছয়তলা বাড়ি, গুলশান একটি ও বনশ্রীতে অভিজাত দুটি ফ্ল্যাট, মিরপুর-১২ নম্বরে বকশীগঞ্জ টাওয়ার নামের সাততলা বাড়ি। এছাড়া রয়েছে বিলাসবহুল একাধিক গাড়ি।

গ্রামের বাড়ি জামালপুরে রয়েছে কয়েকশ শতক জমি। এছাড়া ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাশেদ এন্টারপ্রাইজ নামে দুটি জাহাজ, মেসার্স ফারাহ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, ইভা এন্টারপ্রাইজ, ওয়েল টেক্স, সাবাবা অ্যাপারেলস, এডিএম ডায়িং, পাণ্ডুঘর রয়েছে।

জামিনের জন্য তদবির

বাবুল চিশতী এ সবই ব্যাংক লুটের অর্থে করেছেন বলে জানা গেছে। তার বিরুদ্ধে চলমান মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহ ও পদ্মা ব্যাংকে পরিচালক হিসেবে ফেরত আসতে চেষ্টা করছেন তিনি। এজন্য বর্তমানে কারাগারে থাকা বাবুল চিশতী জামিনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে সুবিধাপ্রাপ্তদের একটি মহল এজন্য চেষ্টাও করছেন বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এজন্য বার্ধক্যজনিত ও অসুস্থতাকে সরকারের নীতিনির্ধারকদের নজরে আনার চেষ্টা করছেন।

ব্যাংক খাত বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যাংক ব্যবস্থা পরিচালিত হয় কাগজপত্রের আলোকে। এখানে অনিয়ম করলে একসময় তা অবশ্যই ধরা পড়বে। বাবুল চিশতীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। এখন আদালতে তার বিচার চলছে। এই সময়ে তাকে জামিন দেওয়া মানেই এ খাতের প্রতি বিরূপ প্রভাব পড়বে। জনমনে ভিন্ন ধারণার বিশ্বাস জন্মাবে। সুশাসনের জন্যই তার বিরুদ্ধে বিচারাধীন মামলাগুলোর কার্যক্রম দ্রুত নিষ্পত্তি করা দরকার। এতে দুষ্কৃতকারীরা ভবিষ্যতে অপরাধ করতে গিয়ে শতবার ভাববে।