ইসমাইল আলী: পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হয় গত ২৫ জুন। আর ২৬ জুন সকাল থেকে সাধারণ জনগণের চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় সেতুটি। যদিও এক দিন পর থেকে পদ্মা সেতুতে বাইক চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়, যা এখনও বহাল আছে। তবে এর খুব একটা প্রভাব পড়েনি পদ্মা সেতুর আয়ে। সেতুটিতে চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি টোল আদায় হয়েছে।
যদিও পিছিয়ে নেই যমুনা নদীর ওপর নির্মিত দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ বঙ্গবন্ধু সেতুও। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে এ সেতু দিয়ে যানবাহন পারাপার হয়েছে পদ্মা সেতুর চেয়ে অনেক বেশি। তবে টোলের হার কম হওয়ায় এ সময় বঙ্গবন্ধু সেতুতে টোল আদায় হয়েছে পদ্মা সেতুর তুলনায় কিছুটা কম।
সেতু বিভাগের তথ্যমতে, জুলাই মাসে পদ্মা ও বঙ্গবন্ধু উভয় সেতু দিয়ে রেকর্ড পরিমাণ যানবাহন পারাপার হয়। এতে ওই মাসে টোলও রেকর্ড
পরিমাণ আদায় হয়। মূলত ঈদুল আজহার কারণে ওই মাসে ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলায় গাড়ি চলাচল বেশি ছিল। এজন্য জুলাই মাসে সেতু দুটি দিয়ে গাড়ি পারাপারের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। এছাড়া একক দিন হিসেবেও দুই সেতুতে ঈদের আগে রেকর্ড পরিমাণ টোল আদায় হয়।
জুলাই মাসে পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন পারাপারের সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ ৮৭ হাজার। এতে ওই মাসে সেতুটিতে টোল আদায় হয় ৭৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আগস্টে পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন পারাপার হয় চার লাখ ১২ হাজার ৩০৬টি। এতে টোল আদায় হয় প্রায় ৬২ কোটি টাকা। অর্থাৎ দ্বিতীয় মাসেই সেতুটিতে যানবাহন পারাপার কমে যায় প্রায় দেড় লাখ। ফলে টোল আদায়ও সাড়ে ১৬ কোটি টাকা কম হয়।
সেপ্টেম্বরে পদ্মা সেতুতে যানবাহন পারাপারের সংখ্যা আরও কমে দাঁড়ায় তিন লাখ ৮৭ হাজার ৬৩৩টি। আর টোল আদায় কমে দাঁড়ায় ৫৯ কোটি ছয় লাখ টাকা। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে পদ্মা সেতুতে গাড়ি পারাপার কমেছে প্রায় ২৫ লাখ এবং টোল আদায় কমেছে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। তবে তিন মাস মিলিয়ে পদ্মা সেতু পারাপার হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ ৮৭ হাজার যানবাহন এবং টোল আদায় হয়েছে ১৯৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
এদিকে জুলাই মাসে বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে যানবাহন পারাপারের সংখ্যা ছিল সাত লাখ ৮০ হাজার ২৩৮টি। এতে ওই মাসে সেতুটিতে টোল আদায় হয় ৬৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এটি বঙ্গবন্ধু সেতুর ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টোল আদায়। এছাড়া আগস্টে সেতুটি দিয়ে যানবাহন পারাপার হয় পাঁচ লাখ ৬৬ হাজার ৬৪৩টি। এতে টোল আদায় হয় ৫৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। ওই মাসে সেতুটিতে যানবাহন পারাপার কমে প্রায় দুই লাখ ১৫ হাজার। ফলে টোল আদায়ও কমে ১২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধু সেতুতে যানবাহন পারাপারের সংখ্যা আরও কমে দাঁড়ায় পাঁচ লাখ ২৫ হাজার ৪৯৯টি। আর টোল আদায় কমে দাঁড়ায় ৪৯ কোটি ১১ লাখ টাকা। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধু সেতুতে গাড়ি পারাপার কমেছে প্রায় ৪১ লাখ এবং টোল আদায় কমেছে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। তবে তিন মাস মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু পারাপার হয়েছে ১৮ লাখ ৭২ হাজার যানবাহন এবং টোল আদায় হয়েছে ১৬৯ কোটি টাকা।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে পদ্মা সেতুতে বঙ্গবন্ধু সেতুর তুলনায় ৩০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা বেশি টোল আদায় হয়েছে। তবে বঙ্গবন্ধু সেতুতে তিন মাসে পদ্মা সেতুর তুলনায় প্রায় পাঁচ লাখ যানবাহন বেশি পারাপার হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঈদের মাসগুলোয় বঙ্গবন্ধু সেতুতে সাধারণত যানবাহন পারাপার বেশি হয়। এতে ওই মাসগুলোয় এমনিতেই টোল আদায় বেশি হয়। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও তেমনটি হয়েছে। তবে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর অনেকেই শখের বসে সেতুটি পারাপার হয়েছেন। ফলে প্রথম মাসে গাড়ি পারাপার ও টোল আদায় বেশি ছিল। পরের মাস থেকে মোটামুটি স্বাভাবিক যানবাহন চলাচল করছে।
তথ্যমতে, ঈদুল আজহার আগে ৮ জুলাই পদ্মা সেতুতে সর্বোচ্চ টোল আদায় হয়েছে। ওইদিন সেতুটিতে টোল আদায়ের পরিমাণ ছিল চার কোটি ১৯ লাখ টাকা। এছাড়া তিন কোটি টাকার বেশি টোল আদায় হয়েছে জুলাই মাসে আরও আট দিন। তবে পরের দুই মাসে সেতুটিতে টোল আদায় তিন কোটি টাকার ঘর অতিক্রম করতে পারেনি। আর ঈদুল আজহার দিন (১০ জুলাই) সর্বনি¤œ টোল আদায় হয় সেতুটিতে। ওইদিন টোল আদায়ের পরিমাণ ছিল এক কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
এদিকে পদ্মা সেতুতে সবচেয়ে বেশি যানবাহন পারাপার হয় উদ্বোধনের পরের দিন অর্থাৎ ২৬ জুন। ওইদিন সেতুটি দিয়ে যানবাহন পারাপারের সংখ্যা ছিল ৫১ হাজার ৩১৬টি। তবে এর প্রায় ৭৫ শতাংশই ছিল বাইক। আর বাইক বন্ধের পর ৮ জুলাই পদ্মা সেতু দিয়ে সর্বোচ্চ যানবাহন পারাপার হয়। সেদিন সেতুটি দিয়ে যানবাহন পারাপারের সংখ্যা ছিল ৩১ হাজার ৭২৩টি।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু সেতুর ইতিহাসে একক দিন হিসেবে সর্বোচ্চ টোল আদায় হয় ৭ জুলাই। ওইদিন সেতুটিতে টোল আদায়ের পরিমাণ ছিল তিন কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এছাড়া গত অর্থবছর বঙ্গবন্ধু সেতুতে সর্বোচ্চ ৭০৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা টোল আদায় হয়। আর একক মাস হিসেবে গত বছর ডিসেম্বরে সেতুটিতে সর্বোচ্চ টোল আদায় হয়। ওই মাসে টোল আদায়ের পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ৪১ লাখ টাকা টোল।
প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধন করা হয়েছিল ১৯৯৮ সালের ২৪ জুন। এর পর থেকে ২৪ বছর তিন মাসে সেতুটিতে টোল আদায় হয়েছে সাত হাজার ৩৬৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। যদিও সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল তিন হাজার ৭৪৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতু পারাপারের জন্য বাইকের টোল দিতে হয় ৫০ টাকা। আর হালকা যান তথা কার ও জিপের টোল ৫৫০ টাকা এবং মাইক্রোবাস ও পিকআপে (দেড় টনের কম) ৬০০ টাকা। এছাড়া ছোট বাসের (৩১ আসন বা তার কম) টোল ৭৫০ টাকা এবং বড় বাসের (৩২ আসন বা তার বেশি) টোল এক হাজার টাকা। এছাড়া পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে সেতুটিতে ছোট ট্রাকে (দেড় থেকে পাঁচ টন) টোল এক হাজার টাকা, মাঝারি ট্রাকে (পাঁচ থেকে আট টন) এক হাজার ২৫০ টাকা এবং বড় ট্রাকে (আট থেকে ১১ টন) এক হাজার ৬০০ টাকা।
এর বাইরে বঙ্গবন্ধু সেতুতে তিন এক্সেলের ট্রাকে টোল দুই হাজার টাকা এবং চার এক্সেল পর্যন্ত ট্রেইলারের টোল হবে তিন হাজার টাকা। আর চার এক্সেলের বেশি সক্ষমতার ট্রেইলারে প্রথম চার এক্সেলের জন্য তিন হাজার টাকার সঙ্গে বাড়তি প্রতি এক্সেলের জন্য এক হাজার টাকা করে যোগ হবে।
পদ্মা সেতুতে বাইক পারাপারে টোল ধরা হয়েছে ১০০ টাকা। যদিও উদ্বোধনের পর শুধু ২৬ জুন সেতুতে বাইক চলাচল করেছিল। এছাড়া প্রাইভেট কার ও জিপে টোল দিতে হয় ৭৫০ টাকা, পিকআপে এক হাজার ২০০ টাকা এবং মাইক্রোবাসে এক হাজার ৩০০ টাকা। আর ছোট বাসে (৩১ আসনের কম) টোল দিতে হয় এক হাজার ৪০০ টাকা, মাঝারি বাসে (৩২ আসন বা তার বেশি) দুই হাজার টাকা এবং বড় বাসে (তিন এক্সেল) দুই হাজার ৪০০ টাকা।
পদ্মা সেতুতে পণ্যবাহী যান চলাচলের জন্য ছোট ট্রাকে (পাঁচ টনের কম) টোল দিতে হয় এক হাজার ৬০০ টাকা, মাঝারি ট্রাকে (পাঁচ থেকে আট টন) দুই হাজার ১০০ টাকা এবং বড় ট্রাকে (আট টনের বেশি) দুই হাজার ৮০০ টাকা। এছাড়া পদ্মা সেতুতে তিন এক্সেলের ট্রাকে টোল দিতে হবে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা। এর বাইরে পণ্যবাহী চার এক্সেলের ট্রেইলারে টোল ছয় হাজার টাকা আর চার এক্সেলের বেশি হলে ছয় হাজার টাকার সঙ্গে পরবর্তী প্রতি এক্সেলের জন্য দেড় হাজার টাকা করে অতিরিক্ত টোল যোগ হবে।