ইসমাইল আলী: পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামোর নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় ২০১৪ সালের নভেম্বরে। চার বছরের মধ্যে তা শেষ করার কথা থাকলেও পরে তিন দফা মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ হিসাবে ২০২১ সালের জুনে নির্মাণকাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যদিও বাস্তবে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাজেট প্রাক্কলন করেছে সেতু কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণ অগ্রগতি নিয়েও দেখা দিয়েছে বিভ্রান্তি।
তথ্যমতে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামোর নির্মাণকাজের অগ্রগতি দেখানো হয়েছে ৮৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। এ সময়ে নদীশাসনের কাজ হয়েছে ৬৬ শতাংশ। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ওয়েবসাইট ও সেতু কর্তৃপক্ষের সর্বশেষ অগ্রগতির প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। গত ১৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ফাস্ট ট্র্যাক মনিটরিং কমিটির বৈঠকেও এ তথ্য জানানো হয়েছে। এছাড়া গত ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদেও একই তথ্য তুলে ধরেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
যদিও পদ্মা সেতুর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসয়ের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভিন্ন তথ্য। গত ২০ জানুয়ারি সেতু বিভাগে জমা দেওয়া পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মূল সেতুর অবকাঠামোর নির্মাণ অগ্রগতি ছিল ৭৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আর নদীশাসন কাজের অগগ্রতি ৬৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ মূল সেতুর অগ্রগতি প্রায় ১০ শতাংশ বেশি দেখিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ। আর নদীশাসনের অগ্রগতি প্রায় আড়াই শতাংশ কম দেখানো হয়েছে।
জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের ক্ষেত্রে অনেক ছোট ছোট কম্পোনেন্ট আছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এগুলো বিবেচনা করে না। তাই তাদের হিসাবে মূল সেতুর অগ্রগতি ১০ শতাংশ কম দেখানো হচ্ছে।
অগ্রগতি বেশি দেখানোয় পদ্মা সেতুর বাস্তব নির্মাণকাজ শেষ হতে দেরি হবে কি নাÑজানতে চাইলে তিনি বলেন, না, এতে কোনো সমস্যা হবে না। সব কম্পোনেন্ট সমন্বয় করলে নির্মাণকাজ নির্ধারিত সময়েই শেষ হবে।
যদিও ২০২২ সালের আগে প্রকল্পটির কাজ শেষ হবে না বলে মনে করছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি রাজধানীর সেতু ভবনে অনুষ্ঠিত পদ্মা সেতুর প্রকল্পের বাজেট বরাদ্দ-সংক্রান্ত বৈঠকে এ তথ্য উঠে আসে।
এতে জানানো হয়, ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত পদ্মা সেতুর প্রকল্প ব্যয়ের ৬৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ বা ১৯ হাজার ৪২৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। বাকি অর্থ তিন বছরে (২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত) ব্যয় হবে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছর প্রকল্পটির জন্য বাজেট বরাদ্দ ছিল পাঁচ হাজার ৩৭০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তব অগ্রগতি কম হওয়ায় চার হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হচ্ছে না। তাই চলতি অর্থবছরের জন্য সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ কমানোর প্রস্তাব করা হবে।
এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য প্রকল্পটির সম্ভাব্য বাজেট প্রাক্কলন করা হয়েছে পাঁচ হাজার ১৭০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য সম্ভাব্য বাজেট প্রাক্কলন করা হয়েছে এক হাজার ৫৯৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কাগজে-কলমে ২০২১ সালের জুনে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হবে বলেই ধরা আছে। সর্বশেষ প্রকল্পটির মেয়াদ বৃদ্ধি করে এ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। আগামী দেড় বছরে সেতুটির পুরো কাজ শেষ নাও হতে পারে। তাই বাজেট বিশ্লেষণ করে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ধরা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মূল সেতুর নির্মাণকাজের অগ্রগতির সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং নদীশাসনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৮১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। অর্থাৎ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এখনও কিছুটা পিছিয়ে ছিল মূল সেতুর কাজ। আর নদীশাসনের অগ্রগতি পিছিয়ে আছে অনেকটাই।
এদিকে পদ্মা সেতু প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতিও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে আছে। সেতুটির মূল অবকাঠামো নির্মাণের চুক্তিমূল্য ধরা হয়েছে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। আর নদীশাসনের চুক্তিমূল্য আট হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
২০২১ সালের জুনের মধ্যে মূল সেতুর কাজ শেষ করতে হলে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ হাজার ৮৯৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকার কাজ শেষ করে ঠিকাদারের বিল উত্তোলনের কথা ছিল। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ কন্সট্রাকশন কোম্পানি ডিসেম্বর পর্যন্ত বিল জমা দিয়েছে সাত হাজার ২৩৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আর বিল পরিশোধ করা হয়েছে সাত হাজার ৯২ কোটি সাত লাখ টাকা।
এছাড়া সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ডিসেম্বর পর্যন্ত নদীশাসনের বিল জমা দেওয়ার কথা ছিল চার হাজার ৮১৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা। কিন্তু ঠিকাদারি কোম্পানি সিনোহাইড্রো করপোরেশন ডিসেম্বর পর্যন্ত বিল জমা দিয়েছে চার হাজার ৪৮৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আর বিল পরিশোধ করা হয়েছে চার হাজার ৪১১ কোটি ২০ লাখ টাকা।