পদ্মা সেতুর পূর্ণ সুফল পেতে নতুন ধারার জ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনা দরকার!

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: পদ্মা সেতুর প্রধানতম মানবিক উপযোগ হচ্ছে দেশের মধ্য-পশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ফেরি পারাপারের দীর্ঘ সময় অপচয় ও কষ্ট লাঘবকরণ। এর অর্থনৈতিক উপযোগ হচ্ছে কর্মমুখী যাত্রী ও পণ্যবাহী যানের সময়, জ্বালানি খরচ, শ্রমঘণ্টা সাশ্রয়, জরুরি স্বাস্থ্য ও সেবা খাতের সময় সাশ্রয়। এই অঞ্চলকেন্দ্রিক কাঁচা ও পচনশীল কৃষি ফলন ও মৎস্য অর্থনীতিকে গতিশীল করবে পদ্মা সেতু। বর্তমানে ফেরি পারাপারে সময়ভেদে গড়ে দেড় থেকে তিন ঘণ্টা প্রয়োজন (ঈদ ও যানজটে প্রায় ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত), যা পদ্মা সেতুর মাধ্যমে মাত্র ১৫ মিনিটে নেমে আসবে।

এক. ঢাকার প্রবেশ মুখ যানজট মুক্ত রাখা জরুরি: পদ্মা সেতু দিয়ে খুব কম সময়ে পেছনের পথ পেরিয়ে বুড়িগঙ্গার সেতুদ্বয়ে এলেও ঢাকার প্রবেশমুখের যান চলাচল ব্যবস্থাপনা উন্নত না করলে এখানে পেছনের রাস্তায় এসে অর্জিত শ্রমঘণ্টা, কষ্ট এবং অর্থনৈতিক উপযোগগুলোর (অপরচুনিটি কস্ট) কিছু অংশ অপচয় হয়ে যাবে। বিশেষ করে পোস্তগোলা সেতু-পোস্তগোলা বাসস্ট্যান্ড এবং বাবুবাজার সেতু-বাবুবাজার মোড় ঢাকার এই দুই প্রবেশ ও বাহিরপথের যানজট নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পদ্মা সেতুর পূর্ণ সুফল ভোগ করা যাবে না। বর্তমানে ফেরি পারাপারের ধীরতার কারণে পিক আওয়ারে ঢাকামুখী যানের মোট সংখ্যা সময়ের হারে বেশ কম। ফলে পদ্মা সেতু চালু হলে দিনের ব্যস্ত সময়ে দুই প্রবেশমুখের ট্রাফিক প্যাটার্ন পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। ঢাকার প্রবেশপথকে যানজটমুক্ত রাখা তাই পদ্মা সেতুর পূর্ণ সুফল কিংবা সব অর্থনৈতিক উপযোগ লাভের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।

দুই. বিমানবন্দর ও ঢাকা বাইপাস করা আন্তঃজেলা ট্রাফিক রাজধানীর ট্রাফিক থেকে আলাদা করা: মাওয়া ফেরিঘাট এবং পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ ফেরিঘাট ব্যবহারকারী সব ট্রাফিকের গন্তব্য ঢাকা নয়। অর্থাৎ পদ্মার অন্য পাড়ের সব মানুষ ও পণ্যের গন্তব্য মূল ঢাকা নয়। অনেকেই ঢাকা বিমানবন্দরের ট্রাফিক এবং উল্লেখযোগ্য অংশ ঢাকা বাইপাস করা ট্রাফিক। ঢাকার সড়ক নকশার একটা উল্লেখযোগ্য ত্রুটি কিংবা দুর্বলতা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও ঢাকা বাইপাস করে দেশের অন্য ৪৩ জেলায় যাওয়ার ট্রাফিক নগর ট্রাফিকের সঙ্গে সংযুক্ত। ফলে ঢাকার প্রবেশমুখের যানজট অর্থনীতিকে ভোগায়। পদ্মা সেতুর সময়, জ্বালানি খরচ, শ্রমঘণ্টার সাশ্রয় এবং পচনশীল পণ্য সুরক্ষাবিষয়ক উপযোগগুলো সঠিকভাবে পেতে হলে দক্ষিণের জেলাগুলোর যে ট্রাফিক গন্তব্য রাজধানীর অভ্যন্তরভাগ নয় বরং বিমানবন্দর এবং অপরাপর জেলা মুখী, সেসবকে ঢাকার প্রবেশ মুখ অর্থাৎ পোস্তগোলা ও বাবুবাজার সেতু থেকেই আলাদা করে ফেলতে হবে। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ড্যাপ, মেট্রোরেল ও বিআরটি পরিকল্পনায় নগরের নিজস্ব ট্রাফিক, বিমানবন্দর ও ঢাকা বাইপাস ট্রাফিকগুলোকে শ্রেণিকৃত করে সড়ক ও রুট নকশার বিষয়কে অতীব গুরুত্ব দেয়া জরুরি।

তিন. দক্ষিণের শিল্প বিকাশ চাইলে টোল হার কমাতে হবে: পদ্মা সেতুতে যানবাহনভেদে ফেরির তুলনায় টোল দিতে হবে ৪২ শতাংশ থেকে সাড়ে ৫১ শতাংশ। ফেরির তুলনায় অতি উচ্চহারে টোল নির্ধারণে পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক প্রাপ্তি কিছুটা কমে আসবে। রাজস্ব আয় বাড়বে কিন্তু ব্যবসার অর্থনৈতিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। সেতুকে সংযোগকারী জেলা থেকে দেশের অন্য প্রান্তে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন খরচ বাড়লে দক্ষিণের জেলাগুলোর উৎপাদিত কৃষিশিল্প পণ্য দেশের অন্য অঞ্চলের সঙ্গে মূল্য সক্ষমতায় পাল্লা দিতে পারবে না।

দক্ষিণাঞ্চল ঝড় ও দুর্যোগপ্রবণ বলে সেখানে শিল্পায়নের হার কম। এদিকে সরকার ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতেও টোল নেবে। ভ‚মি অধিগ্রহণে ব্যাপক খরচসহ নানা কারণে ঢাকা-ভাঙ্গা সড়ক নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে প্রতি বিশ্ব রেকর্ড পরিমাণ খরচ হয়ে গেছে (কিলোমিটারপ্রতি ২০০ কোটি টাকা)। ফলে সেখানেও টোলের হার উচ্চ হওয়ার আশঙ্কা আছে। ঢাকা থেকে দক্ষিণের উপক‚লীয় জেলা পর্যন্ত সড়কে রয়েছে আরও অন্তত দুটি টোল সেতু ও ফেরি। এতগুলো সেতু ও সড়কে উচ্চহারে টোল দিলে, সেটা দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিশিল্প পণ্য ও সেবার মূল্য বেশি হবে, এতে এই অঞ্চলের শিল্প বিকাশ বিঘ্নিত হবে নিশ্চিত। দিনশেষে দক্ষিণের মানুষের পকেট কাটার উপকরণ হয়ে উঠবে সড়ক ও সেতুর টোল।

চার. দূরত্ব, জ্বালানি খরচ এবং টোল হারের ত্রিপক্ষীয় সমন্বয়: দেশের মধ্য-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোর পণ্য ও যাত্রীবাহী বাহনগুলো প্রধানত পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ ফেরিঘাট ব্যবহার করে ঢাকায় প্রবেশ করে ও বের হয়, এই জেলাগুলো হচ্ছে সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, রাজবাড়ী, ফরিদপুর প্রভৃতি। অন্যদিকে দেশের মধ্যাঞ্চলের বেশ কিছুসহ মূলত দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো মাওয়া-জাজিরা ফেরিঘাট ব্যবহার করে থাকে। এগুলো হচ্ছে মোংলা, খুলনা, বাগেরহাট, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা প্রভৃতি। এই দুই ফেরিঘাট হয়ে রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলায় সড়ক যোগাযোগ চলে।

মাওয়া-জাজিরায় পদ্মা সেতু চালু হলেও, দেশের মধ্য-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোর পণ্য ও যাত্রীবাহী বাহনগুলো অর্থাৎ পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ ফেরিঘাট ব্যবহারকারী যানবাহনের পদ্মা সেতু ব্যবহার করার সম্ভাবনা কিছুটা কম হবে। কারণ দূরত্ব বেশি বলে সময় ও জ্বালানি বেশিই লাগবে। তথাপি দুর্যোগ পরিস্থিতি ও যানজটে কিংবা ফেরিপারাপারের কারিগরি সমস্যায় পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ ফেরিঘাট ব্যবহারকারী যানবাহনের কিছু অংশ বেশি দূরত্ব পাড়ি দিয়েও পদ্মা সেতু ব্যবহার করার প্রবণতা দেখাবে। এই নতুন ঝোঁক (ট্রাফিক রি-ডিস্ট্রিবিউশন) বাস্তবতা পাবে কি পাবে না, তা তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এক. বাবুবাজার ও পোস্তগোলা সেতু ঢাকার এই দুই দখিনা প্রবেশমুখে যানজটের পরিবর্তিত পরিস্থিতি। দুই. বর্ধিত যাত্রাপথের দৈর্ঘ্য ও জ্বালানি খরচের নতুন বিন্যাস (কস্ট বেনিফিট)। তিন. টোলের হার। প্রথম দুটি নিয়ামককে টোলের নিন্ম হার দিয়ে কমপেনসেইট করা যাবে কিছুটা। বিপরীতে অধিক জ্বালানি পুড়িয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার পর যাত্রী বা পণ্যবাহী যানের কোনোটাই উচ্চ টোল দিয়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে চাইবে না। এতে অর্থনীতির স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগে, জ্যামে পড়লে, ফেরিতে কারিগরি সমস্যা, কুয়াশা কিংবা ঝড়ে পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ রুটে ফেরি চলাচলে সমস্যা হলে সেখানকার যানবাহনের কিছু অংশ বিকল্প পথ হিসেবে বেশি দূরত্ব পাড়ি দিয়েও পদ্মা সেতু ব্যবহার করার চেষ্টা করবে। এতেও অর্থনৈতিক উপযোগ আসবে। কিন্তু টোল বেশি হলে এটা সম্ভব হবে না, একদিকে বেশি দূরত্বের কারণে জ্বালানি খরচ বেশি হবে, অন্যদিকে কয়েক হাজার টাকা টোল বেশি দিতে হবে। পদ্মা সেতুর প্রস্তাবিত টোলে দূরত্ব, জ্বালানি খরচ এবং অর্থনৈতিক উপযোগ তৈরির ত্রিপক্ষীয় সমন্বয় নেই।

গতানুগতিক বেশি রাজস্ব আয়ের উদ্দেশ্যেই তৈরি হয়েছে পদ্মা সেতুর টোল হার। এটা অর্থনৈতিক বিকাশে সার্বিক গতি আনার জন্য বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তাতাড়িত নয়। মোটরযান চলাচলের জন্য সারাদেশে উপযোগী রাস্তা করতে সরকার অতি উচ্চহারে বার্ষিক রুট-ফি নেয়, বিগত দশকে যা বাড়াতে বাড়াতে প্রায় তিন গুণ হয়েছে। ফলে বাড়তি রাজস্ব আয়ের কৌশল থেকে সরে এসে পদ্মা সেতুর টোল ফি কমানো উচিত, টোলের সর্বোচ্চ হার ফেরির হারে সমাজ হতে পারে, টোল হার ফেরির অর্ধেক হলে দক্ষিণের শিল্প বিকাশের জন্যই তা বেশি ভালো।

পাঁচ. গতানুগতিক নয়, বুদ্ধিদীপ্ত নতুন টোল ব্যবস্থা: বাংলাদেশের টোলের অর্থ হারে বিভিন্ন স্তরের বৈষম্য আছে। সাধারণ গাড়ি, জিপ, মাইক্রোবাস সবার একই হার বিস্ময়কর। লাখ টাকার গাড়ি এবং কোটি টাকার ব্যক্তিগত গাড়ির টোল হার একই। নিন্মবিত্তের মুড়ির টিন মার্কা যাত্রী পরিবহনকারী বাসের টোল বিলাসবহুল বাসের টোলও প্রায় একই। এভাবে ধনী তোষণই দেশের উন্নয়ন-দর্শন। আবার খালি ট্রাক, সাধারণভাবে লোডেড ট্রাক এবং মাত্রাতিরিক্ত ওভারলোডেড ট্রাক বা কনটেইনারের ভাড়া একই। এমনটা ব্যবসাবান্ধব নয়।

যানবাহনের প্রকারভেদ নয় বরং আধুনিক যুগে টোলের হার নির্ভর করে মোটরযানের লোড বা ভারের বিপরীতে। গতানুগতিক টোল হার সংগ্রহের স্মার্ট পাসই টোল ব্যবস্থার স্মার্ট দিক নয়। স্থির টোল হারের বদলে ডায়নামিক অর্থাৎ স্মার্ট টোল ব্যবস্থা করা দরকার পদ্মা সেতুতে। দরকার মোটরযানের লোডভিত্তিক টোল হার। স্থির ও গতানুগতিক হারের টোল সংগ্রহের জন্য যে বিদেশি ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তার খরচও বর্ধিত টোল হারের জন্য দায়ী হতে পারে।

দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি, মৎস্য, ক্ষুদ্র শিল্পসহ প্রান্তিক অর্থনীতি এবং সার্বিক শিল্প উৎপাদনকে মূল্য প্রতিযোগিতা এবং সক্ষমতায় এগিয়ে রাখার বিবেচনায় স্থানীয় অর্থনীতিবান্ধব, খাতভিত্তিক টোলব্যবস্থা দরকার, যেখানে উচ্চবিত্ত বেশি টোল পরিশোধ করবে এবং নিন্মবিত্ত করবে নামমাত্র। ভারী গাড়ি বেশি টোল দেবে, খালি কিংবা হালকা গাড়ি দেবে কম। পাশাপাশি কৃষিসেবা ও শিল্পের বিশেষ বিশেষ খাতভিত্তিক সাশ্রয়ী টোল হারের বিবেচনা দরকার। গতানুগতিক নয় বরং সাশ্রয়ী এবং বুদ্ধিদীপ্ত টোল হারই পদ্মা সেতুর কাক্সিক্ষত অর্থনৈতিক উপযোগিতা তৈরি করতে পারবে দক্ষিণাঞ্চলের জন্য।

ছয়. অতিরিক্ত নদী শাসনের বিপদ নিয়ে সজাগ থাকা চাই: পদ্মা সেতুর প্রাথমিক নকশায় ত্রæটি ছিল। নকশা প্রণয়নে প্রতিটি পিলারের তলদেশে মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করা হয়নি। মাত্র ১১টি পিলারের তলদেশের মাটি পরীক্ষা করে বাকি ৩১ পিলারের মাটি পরীক্ষা না করেই অনুমান ভিত্তিতে প্রণয়ন করা হয় ৪২টি পিলারের নকশা। এতে বাস্তবায়নের সময় গিয়ে, নকশায় বর্ণিত মাটির গুণাগুণের সঙ্গে পদ্মার তলদেশের মাটির প্রকৃত অবস্থা মিলেনি। ডিজাইন চূড়ান্ত হওয়ার পর পদ্মার গভীরে অন্তত ১৪টি পিলারের নিচে ৩৫০ থেকে ৪০০ ফুট কাদার স্তর পাওয়া গিয়েছে; ফলে প্রতিটি পিলারের তলদেশে মাটির গুণাগুণ পুনঃপরীক্ষাও করতে হয়েছিল। এর ফলে পদ্মা সেতুর কাজের ক্রমপর্যায় মানা যায়নি। অর্থাৎ পাইল, পিয়ার, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক নির্মাণের মূল কাজগুলো আন্তর্জাতিকভাবে বিধিবদ্ধ ধারাবাহিকতায় মানা যায়নি।

পদ্মা সেতুর নির্মাণকালেই সেতু প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডের বিস্তীর্ণ এলাকা নদীতে বিলীন হয়েছিল। এতে ধারণা হতে পারে, সেতু প্রকল্পের নদী ভাঙনের নকশা বা ইরোশান ম্যাপ এবং নদী শাসনের পরের প্রাক্কলিত ভাঙনের মডেলে শতভাগ নিখুঁত ছিল না। অভিযোগ আছে যে, নদী শাসনে অনুমোদনহীন জিও টেক্সটাইল উপকরণ ব্যবহার করেছে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন। এজন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে সনদ সংগ্রহের সুপারিশ করেছে পদ্মা সেতুর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে কনসোর্টিয়াম।

গত নভেম্বরে নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রকাশিত টেকনিক্যাল জার্নালে স্যাটেলাইট ছবির মাধ্যমে গত চার দশকের তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরুর পর সেতুর ভাটিতে ভাঙন বেড়েছে, নড়িয়াসহ পদ্মা সেতুর ভাটি অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ভাঙন হয়েছে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সময়কালে। বুয়েটের ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) তিন বিশেষজ্ঞ পরিচালিত গবেষণা ‘অ্যাসেসিং রিভারব্যাংক ইরোশন অ্যাট আপস্ট্রিম অ্যান্ড ডাউনস্ট্রিম সাইড অব পদ্মা ব্রিজ বাই ইউজিং স্যাটেলাইট ইমেজেস’ প্রতিবেদনে বলা হয়, গত পাঁচ বছরে পদ্মা সেতুর ভাটি অঞ্চলে ভাঙনের পরিমাণ বেড়েছে আগের পাঁচ বছরের তুলনায় ১ হাজার ১০০ মিটারেরও বেশি। একই পরিস্থিতি সেতুর উজানেও। আগের পাঁচ বছরের চেয়ে গত পাঁচ বছরে উজানে ভাঙনের শিকার এলাকার আয়তন বেড়েছে দেড় হাজার মিটারেরও বেশি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সেতু নির্মাণের আগে সুপারিশকৃত এসব পদক্ষেপ ও দিকনির্দেশনার যথাযথ বাস্তবায়নের অভাবেই পদ্মার ভাটি এলাকায় ভাঙনপ্রবণতা বাড়ছে। ফলে অতিরিক্ত নদী শাসনের বিপদ নিয়ে সরকারকে সর্বোচ্চ সজাগ থাকার পরামর্শ দিই, যাতে টোলে থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব নদী ভাঙনের ক্ষতি রোধে খরচ হয়ে না পড়ে।

সাত. জমির লাগামহীন দাম বৃদ্ধি শিল্প বিকাশের অন্তরায় হতে পারে। পদ্মা সেতুর কারণে আশপাশের এলাকায় হুহু করে বাড়ছে জমির দাম। দাম বৃদ্ধির শুরুটা সেতুর ভূমি অধিগ্রহণ থেকেই শুরু হয়েছে। খালি জায়গায় আধাকাঁচা, স্থায়ী-অস্থায়ী অবকাঠামো তুলে জমির দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে, তার রাশ এখনও থামানো যায়নি। এক যুগে জমির দাম বেড়ে গেছে ১২ থেকে থেকে ১৫ গুণ। এটা দক্ষিণের শিল্পবিকাশে প্রতিবন্ধক, শিল্পের বিনিয়োগের অর্থ জমি কেনায় চলে গেলে শিল্প গড়া দুরূহ। ফলে সরকারকে বিচ্ছিন্নভাবে শিল্পও গড়ার অপেক্ষায় না থেকে পদ্মার দুই পাড়ে ‘অর্থনৈতিক অঞ্চল’ নিয়ে ভাবতে হবে।

দক্ষিণাঞ্চল দুর্যোগপ্রবণ বলেও সেখানে শিল্প বিকাশ কম ছিল। পদ্মা সেতু না থাকায় পদ্মার ওপারে শিল্প বিকাশ হয়নি সত্য, তবে অতীতে পদ্মার এপাড়েও শিল্প বিকাশ হয়নি। তাই অর্থনৈতিক অঞ্চল করে জমি প্রাপ্তি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সংযোগে দ্রæত পদক্ষেপ না নিলে যমুনা সেতু অঞ্চলের মতো অনুৎপাদনশীল বিনিয়োগের অভিজ্ঞতা হবে অনেকেরই। শুধু জমি ক্রয়নির্ভর বেসরকারি বিনিয়োগ সত্যিকারের উৎপাদনশীলতা বাড়াবে না।

আট. পর্যটন, ফেরিঘাটের স্থানীয় ব্যবসা শ্রমের রূপান্তর: পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে সাময়িক পর্যটনের যে স্থানীয় বিকাশ হয়েছে, তা সময়ের সঙ্গে কমে আসবে; কারণ এটা সেতু দেখাকেন্দ্রিক। সরকারকে পর্যটন বিকাশের নতুন নতুন উপাদান ও অনুষজ্ঞ নিয়ে ভাবার পরামর্শ দিই। পাশাপাশি ফেরিঘাটের দুই পাড়ের ক্ষুদ্র ব্যবসা, খাবার রেস্তোরাঁ, হকারদের কর্ম কীভাবে অন্য পেশায় রূপান্তরিত করা হবে, তা নিয়েও ভাবা চাই। লঞ্চ ও ফেরিতে ঘুরে ঘুরে যাত্রীদের কাছে বিক্রি করেন ঝালমুড়ি, ছোলা, সিদ্ধ ডিম, শিঙাড়া, শনপাপড়ি, তিলের খাজা, ভাত-ইলিশ, শসা, গাজর, পেয়ারা, দইসহ নানা ধরনের মুখরোচক খাবার। পাশাপাশি ভাবতে হবে ফেরিঘাটের চাঁদাবাজদের নিয়েও। ফেরিঘাটের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাঁদাবাজরা যাতে পার্শ্ববর্তী এলাকার সড়ক, বাস ও ট্রাকস্ট্যান্ডে গিয়ে পুনরায় চাঁদাবাজি করতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।

নয়. পদ্মা রেলের বিকাশে যৌক্তিক পদক্ষেপ দরকার: দ্বিতল পদ্মা সেতুর নিচতলায় এক লাইনের ট্রেন চলাচলের রেললাইন আছে। এজন্য রেলওয়ে ডেক ভায়াডাক্ট সংযোগ তৈরি হয়েছে। তবে পদ্মা সেতুর রেল সংযোগের জন্য চায়নিজ ঋণনির্ভর আলাদা প্রকল্প রয়েছে। সম্প্রতি পদ্মা সেতুর নির্মাণব্যয়ের ১৭ শতাংশ রেলের কাছে চেয়েছে সেতু বিভাগ। আলাদা আলাদা দেশি-বিদেশি উৎস থেকে তৈরি ফান্ডে নির্মিত সেতু এবং রেলের খরচ নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় ব্যবসা চলা উচিত নয়। এভাবে জটিলতা তৈরি না করে পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে রেলের দক্ষ ও সময় সাশ্রয়ী পরিচালনা নিশ্চিত করতে হবে। মাত্র এক লাইনের রেলপথ হওয়ায় রেলজট এড়াতে দুই পাড়ের রেলস্টেশনগুলোকে বিশেষ দক্ষ করে তোলা না গেলে শিল্প, পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে অর্থনৈতিক উপযোগ খুব বেশি আনা যাবে না। পাশাপাশি পদ্মা রেলকে কীভাবে দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক পণ্য পরিবহন, লাভজনক ভারতীয় ট্রানজিট এবং দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রী পরিবহনের সঙ্গে ভালোভাবে ইন্টিগ্রেটেড করা হবে তার সুগভীর ভবিষ্যৎমুখী পরিকল্পনা চাই।

সবমিলে পদ্মা সেতুকে অর্থনৈতিক বিকাশের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে সেতু সড়ক রেল ও টোল ব্যবস্থাপনায় নতুন বোধ তৈরি করতে হবে। তবেই পদ্মা সেতু থেকে সর্বোচ্চ সুফল তুলে আনা যাবে।

টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক, বুয়েট প্রকৌশলী, সিনিয়র সলুশন আর্কিটেক্ট, ভোডাফোন জিজ্ঞো নেদারল্যান্ডস। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর, অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা, উন্নয়ন প্রশ্নে বাংলাদেশের কিছু সংকট ও সম্ভাবনা

faiz.taiyeb@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০