শেখ মোহাম্মদ রতন, মুন্সীগঞ্জ: আগামী ২৫ জুন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে কোটি মানুষের বহুল কাক্সিক্ষত স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এ দিন সকালে সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই দর্শনার্থীদের ভিড় লক্ষ করা গেছে। শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধ নারী-পুরুষ শত শত দর্শনার্থীর বাঁধভাঙা উচ্ছাস এ পদ্মা সেতু ঘিরে। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থী পদ্মা সেতু এক নজর দেখার জন্য পদ্মা পাড়ে এসে ভিড় করছেন।
খরস্রোতা-প্রমত্তা পদ্মার অভ‚তপূর্ব দৃশ্য অবলোকনে এ সেতু দর্শনার্থীদের অন্যতম আকর্ষণ। একদিকে সেতুর সৌন্দর্য্য যেমন দৃষ্টি কাড়ছে অন্যদিকে পদ্মার স্বচ্ছ জলরাশিও টানছে সবার মনপ্রাণ।
গত ৪ জুন সন্ধ্যা থেকে পদ্মা সেতুকে আলোকিত করতে বসানো ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্টে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া শুরু হয়েছে। এতে ধীরে ধীরে আলোকিত হয়ে উঠছে পুরো পদ্মা সেতু। আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হবে এমন খবরে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে জমিদাতাসহ স্থানীয় মানুষের মধ্যে বিজয়ের আনন্দ করতে দেখা গেছে।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের খবর শুনে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের মাওয়ার কুমারভোগ পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দা আরিফুর রহমান খুশিতে আত্মহারা। তিনি জানান, বাপদাদার ভিটেমাটি হারিয়ে শুরুতে বুকফাটা কষ্ট থাকলেও এখন আমরা অনেক খুশি ও গর্ববোধ করছি।
এদিকে, ইট-পাথরের নগর জীবন থেকে মুক্ত পরিবেশে পদ্মার পাড়ে বসে স্বপ্নের এ সেতুর সৌন্দর্য অবলোকন করতে লৌহজংয়ের শিমুলিয়া ফেরিঘাট ও কান্দিপাড়াসহ সেতুর আশপাশের এলাকায় হাজার হাজার দর্শনার্থীর ভিড় যেন মিলনমেলায় রূপ নিয়েছে।
পরিবার নিয়ে রাজধানীর মিরপুর থেকে ঘুরতে আসা বাবুল হোসেন বলেন, স্বপ্নের পদ্মা সেতু শুধু যোগাযোগ বৈপ্লবিক পরিবর্তনই আনবে না, সে সঙ্গে এটি ঘিরে পর্যটন শিল্পের বিশাল এক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাচ্ছে। পদ্মা সেতুর নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলার ছোটাছুটি যে কাউকেই আকৃষ্ট করে। এখানে আসার এক্সপ্রেসওয়ে সড়কটিও অসাধারণ। রং-বেরঙের ফুলের ছন্দময় নৃত্য দেখতে দেখতে যানজটহীন চলে আসা। সবমিলিয়ে পর্যটনের নতুন হাব এখন মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মাওয়া-শিমুলিয়া। ছুটির দিনগুলো ছাড়াও ভ্রমণপিপাসু মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে পদ্মাপাড়, তাই সুযোগ পেয়েই পরিবার নিয়ে দেখতে এসেছি স্বপ্নের এ সেতু।
মিরপুর থেকে ঘুরতে আসা দর্শনার্থী রোকসানা আক্তার জানান, টেলিভিশনে ও পত্র-পত্রিকায় প্রতিদিনই পদ্মা সেতুর খবর পাই। আজকে বাস্তবে দেখার জন্য ছুটে আসি পরিবার নিয়ে। সেতুর ওপরে উঠতে পারলে খুব ভালো লাগতো, নিরাপত্তার কারণে সেনাবাহিনী কাউকেই উঠতে দিচ্ছে না। তাই সম্ভব হয়নি। আমাদের পরিবারের সবার খুবই ভালো সময় কেটেছে।
মাওয়া ঘাটে পদ্মার পাড়ে আসা খুলনাগামী রোমানা বেগম ও সুজানা আক্তার নামে দুই বোন জানান, প্রতিনিয়ত শিমুলিয়া ও বাংলাবাজার ঘাটে এসে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলে আমাদের ভোগান্তি কমার পাশাপাশি সময়ও অনেক কম আসবে। এতে আমরা দিনে দিনে ঢাকায় জরুরি কাজ শেষে আবার বাড়িতে ফিরে আসতে পারব।
ঢাকা থেকে মাওয়া ঘাটে আসা শরীয়তপুরের মুকবুল হোসেন বলেন, পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে নিজেদের টাকায় পদ্মার বুকে গর্বের সেতু দাঁড়িয়েছে। ২৫ জুন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ স্বপ্নের সেতু দিয়ে পারাপার হবে, এটা অনেক বড় আনন্দের খবর। পদ্মা সেতুর কারণে দেশের অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসবে। সরকার সেতু ঘিরে অনেক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কর্মসংস্থান ও পর্যটনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অন্যদিকে সপ্তাহের শুক্রবার ও শনিবার মাওয়া প্রান্তে পদ্মা পাড়ে উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করে। একনজর পদ্মা সেতুর দেখতে উৎসুক জনতার ভিড় জমে সেখানে। পরিবারের সব সদস্যকে নিয়েও কেউ কেউ ছুটে এসেছেন পদ্মাপাড়ে। উৎফুল্ল জনতা সেখানে ক্যামেরাবন্দি করেন নিজেদের। কেউ কেউ পদ্মা সেতুকে ঘিরে সেলফি তুলতে ব্যস্ততম বিকাল অতিবাহিত করেন। আবার অনেকেই ট্রলারে করে পদ্মা নদীতে ঘুরে ঘুরে পুরো সেতু অবলোকন করেন। বেলুন উড়িয়ে উচ্ছ¡াস প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।
ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু পারাপারের জন্য টোলের হার নির্ধারণ করেছে সরকার। গত ১৭ মে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় বিভিন্ন পরিবহণের জন্য আলাদা টোলের হার নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান মো. আব্দুল কাদের জানান, ১৯ মে শেষ হয় পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তের সংযোগ সড়কের পিচ ঢালাই। গেল ২৩ মে জাজিরা প্রান্তের সংযোগ সড়কের পিচ ঢালাইয়ের কাজও শেষ হয়েছে। সেতুর অবশিষ্ট কাজের মধ্যে রোড মার্কিং ও সেতুকে আলোকিত করতে বসানো ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্টে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার কাজ এখন শেষের পথে। পুরোদমে চলছে রেলিং বসানোর কাজ।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় স্বপ্নের পদ্মা সেতু।