পদ্মা সেতু কৃষিতে আনবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন

. রমিজ উদ্দিন: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার অসীম সাহসিকতা ও দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের অবিশ্বাস্য এক রূপকথা পদ্মা সেতু। দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র ভেদ করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বাংলাদেশের সক্ষমতাকে আরও একবার জানান দিয়েছেন বিশ্ববাসীকে। তাই পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতু নয়, এটি বাঙালি জাতির গৌরব, মর্যাদা আর অহঙ্কারের প্রতীক। দেশের মানুষের স্বপ্ন পূরণের অনবদ্য উপাখ্যান। অবাক বিস্ময়ে বিশ্ববাসী নতুনভাবে দেখছে মাথা না নোয়ানো এক নতুন বাংলাদেশকে। গত শনিবার (২৫ জুন) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে সেতুটি উদ্বোধন করেন। পদ্মা সেতু বিশ্বের বড় সেতুগুলোর মধ্যে একটি। পদ্মা সেতু ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৮ দশমিক ১ মিটার প্রস্থবিশিষ্ট একটি অনন্য প্রকৌশল স্থাপনা। একটি বৃহৎ প্রকৌশল স্থাপনা হিসেবে পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিল একটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং কাজ। এই দ্বিতল সেতুটি ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট ৪১টি স্প্যান যোগে ৪০টি সেন্টার পিলারের ওপর স্থাপিত। প্রতিটি পিলার পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ১২২-১২৫ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৩ মিটার প্রস্থবিশিষ্ট ৬-৭টি স্টিল পাইলের ওপর স্থাপিত। পাইলগুলো জার্মানিতে তৈরিকৃত পৃথিবীর সর্বোচ্চ ৩ হাজার কিলোজুল ক্ষমতাসম্পন্ন হ্যামার দ্বারা নদীর তলদেশে প্রবেশ করানো হয়। ৭১টি পাইলকে অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানিকৃত সাধারণ সিমেন্টের চেয়ে ৩০ গুণ অধিক ব্যয়বহুল মাইক্রোফাইন সিমেন্ট দ্বারা স্কিন গ্রাউটিং করা হয়। পদ্মা সেতুটি ৪১টি ইউনিক স্প্যানবিশিষ্ট (অর্থাৎ প্রতিটি স্প্যানের ডিজাইনই আলাদা) ইংরেজি এস আকৃতির ৯২ হাজার ২৮৬ মেট্রিক টন (শুধু স্টিলের অংশ) ওজনবিশিষ্ট একটি স্থাপনা। সেতুটি ১০ হাজার মেট্রিক টন ভার বহনে সক্ষম ৯৬টি সেট বিয়ারিংয়ের ওপর স্থাপিত হওয়ায় এটি ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল একটি স্থাপনা। নদীভাঙন হতে সেতুর নিরাপত্তার জন্য মাওয়া অংশে ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার এবং জাজিরা অংশে ১২ দশমিক ৪ কিলোমিটার নদীশাসনের কাজ করা হয়েছে, যা মূল সেতুর সুরক্ষাসহ বিস্তীর্ণ কৃষি জমিকে নদীভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করে স্থানীয় কৃষি উৎপাদনে বৈষ্ণিক পরিবর্তন ঘটাবে। এই সেতুকে ঘিরে ইতোমধ্যে আশপাশের জেলাগুলোয় শুরু হয়েছে শিল্পায়ন, কৃষিতে এসেছে নতুন জোয়ার, চলছে বনায়নও।

সেতু চালুর পরপরই বদলে যাবে অর্থনীতি। বিশেষ করে কৃষিতে নিঃসন্দেহে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সেতুর কারণে বাড়বে কৃষি পণ্যের উৎপাদন। দ্রুত স্থানবদল হবে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে যাবে। আর প্রতি বছর দারিদ্র্য নিরসন হবে দশমিক ৮৪ শতাংশ। এর মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় ছয় কোটি মানুষের ভাগ্যে পরিবর্তন আনবে পদ্মা সেতু। এক সময় দেশের উত্তরাঞ্চলে মঙ্গা দেখা দিত। বঙ্গবন্ধু সেতু উত্তরাঞ্চলের এই মঙ্গা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। ঠিক একইভাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো এখনও শিল্পের দিক দিয়ে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। এ এলাকার বেশ কয়েকটি জেলার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। পদ্মা সেতুর ফলে সবার আগে উপকার হবে এই পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর। কারণ সেতুর কারণে এসব এলাকায় ব্যাপক আকারে শিল্পায়ন কবে, কৃষিতে আসবে আমূল পবিবর্তন, লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। মানুষের আয় বাড়বে এবং পরিবর্তন আসবে জীবন-জীবিকায়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। এছাড়া, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জনে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির জন্য যে খাতগুলো থেকে সবচেয়ে বেশি মুনাফা অর্জন করা সম্ভব তার মধ্যে কৃষি অন্যতম। যে জেলাগুলো এই সেতু থেকে সরাসরি লাভবান হবে বলে আশা করা হচ্ছে সেগুলো হলোÑখুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা। এ ছাড়া বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি এবং ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রথম কোনো সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। মোংলা ও পায়রা বন্দর এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী ও বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পুরো দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। কোনো বিনিয়োগের ১২ শতাংশ রেট অব রিটার্ন হলে সেটি আদর্শ বিবেচনা করা হয়। এই সেতুর ফলে বছরে বিনিয়োগের ১৯ শতাংশ উঠে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। কৃষি, শিল্প, অর্থনীতি, শিক্ষা, বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই পদ্মা সেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে।

সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পদ্মা সেতুর কারণে সবচেয়ে বেশি সুবিধা হবে কৃষিজাত পণ্যের বাজারজাতকরণ ও পরিবহনের ক্ষেত্রে। সেতুর কারণে কৃষক তার পণ্যের সঠিক মূল্য পাবেন। সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ কতভাবে উপকৃত হতে পারে, তা নিয়ে একটি সমীক্ষা করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। চলতি বছর মে মাসে পদ্মা সেতুর দুই পাশের তিন জেলা মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ৭৫০ জনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে আইএমইডি। ৯৫ শতাংশ উত্তরদাতা বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে কৃষিজাত পণ্য বাজারজাতের ফলে সঠিক মূল্য পাওয়া যাবে। ৯৭ শতাংশ উত্তরদাতা বলেন, কৃষিজাত পণ্য বাজারজাতকরণে পরিবহন সুবিধা পাওয়া যাবে। সেতু উদ্বোধন সামনে রেখে বছর অনেক আগে থেকেই নানা ধরনের কাজ শুরু করেছেন কৃষির সঙ্গে জড়িত কৃষক, ব্যবসায়ী ও খামারিরা। বড় ধরনের বিনিয়োগ করেছেন পরিবহন খাতের ব্যবসায়ীরাও। যশোর, খুলনাসহ বেশ কয়েকটি জেলার উদ্যোক্তারা আগে থেকেই বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন যাতে করে সেতু উদ্বোধনের পরপরই এর সুফল পাওয়া যায়। শুরুতেই বড় গতিশীলতা আসবে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার কৃষিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। বিশেষ করে এ এলাকার কৃষক তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবে এবং অল্প সময়ে কৃষি পণ্য রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠাতে পারবে। ফলে কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কমে আসবে ব্যাপকভাবে। খুলনা ও বাগেরহাটের মাছ, যশোরের সবজি আর ফুল, বরিশালের ধান ও পান পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতির ভিত্তি। সেখানকার প্রতিটি জেলায়ই ধান ও মাছ চাষ করা হয়। নদী এলাকা বলে প্রাকৃতিক উৎস থেকেও আসে বিপুল পরিমাণ মাছ। এসব মাছ ঢাকার বাজারে আনা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। এখন সেটিই সহজ হবে বলে আশা করছেন ওই অঞ্চলের মাছচাষিরা। যশোরের গদখালীর ফুল রাজধানীসহ বড় শহরগুলোর পাশাপাশি রপ্তানি হয়। আবার দেশের সবজির বাজারের বড় একটি অংশই আসে যশোর অঞ্চল থেকে। নদী ও সাগরবেষ্টিত জেলা পটুয়াখালী। দশকের পর দশক এই এলাকার পলিযুক্ত উর্বর মাটিতে ফলছে বিভিন্ন ধরনের ফসল। প্রতি বছর এই জেলা থেকে বিপুল পরিমাণ মুগডাল, তরমুজ, আমন ধান থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফসল দেশের অনেক এলাকায় সরবরাহ করা হয়। এমনকি এখানকার উৎপাদিত মুগডাল দেশের গণ্ডি পেরিয়ে রপ্তানিও হয়। পটুয়াখালী থেকে প্রতি বছর প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন মাছ জেলার বাইরে রপ্তানি হয়। মাছ একটি পচনশীল পণ্য এবং এটি বিক্রি করার জন্য নির্দিষ্ট বাজার এবং সময় রয়েছে, পদ্মা সেতুর ফলে পরিবহনে আর বাড়তি সময় লাগবে না। এ কারণে মৎস্যজীবীরা মাছের ভালো দাম পাবেন এবং ক্রেতারাও টাটকা মাছ খেতে পারবেন। মাদারীপুরে প্রচুর পেঁয়াজ, মসুর, সরিষা, ধনিয়াসহ বিভিন্ন কৃষিজাত পণ্য উৎপাদিত হয়। পদ্মা সেতুর ফলে মাদারীপুরের কৃষকরা অতি অল্প সময়ে এসব পণ্য বাজারজাত করতে পারবে। ধারণা করা হচ্ছে মাগুরার লিচুচাষিরাই আগামী বছর থেকে প্রতি মৌসুমে অন্তত ৫০ কোটি টাকার বাড়তি লিচু বিক্রি করতে সক্ষম হবেন। লিচুর পাশাপাশি মাগুরায় প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে সবজি, ১২ হাজার হেক্টরে পেঁয়াজ ও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জমিতে কাঁচা মরিচের চাষ হয়। এসব পণ্য দ্রুত রাজধানীর বাজারে পাঠানো সম্ভব হবে। পাট ও পেঁয়াজ আবাদে দেশের মধ্যে অন্যতম ফরিদপুর জেলা। পাট ইঁদুরে কাটার আগেই আর পেঁয়াজ পচে যাওয়ার আগেই তা স্বপ্নের পদ্মা সেতু দিয়ে যানজট আর ভোগান্তি ছাড়াই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনায়াসে পৌঁছে যাবে। যশোর ও ফরিদপুরের খেজুরের গুড়ের কদর আছে দেশজুড়ে। এখানকার পরিত্যক্ত জমিতে বাণিজ্যিকভাবে খেজুর গাছের বাগান করা যেতে পারে।

এখন ওই অঞ্চলগুলোতে রপ্তানিমুখী কৃষিভিত্তিক পণ্যগুলোর জন্য জোন চিহ্নিত করতে হবে। দেশে কৃষি পণ্যের জন্য পর্যাপ্ত হিমাগার নেই। তাই কৃষিপণ্যের বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে উপযুক্ত স্থান বেছে নেয়াসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এখন। কৃষির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত হবে ভারী শিল্পকারখানা, সমৃদ্ধ হবে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতিসহ পুরো বাংলাদেশ। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে কোনোভাবেই যেন কৃষি জমি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কৃষির উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি রপ্তানিমুখী কৃষিকে আরও সমৃদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা অতি দ্রুত গ্রহণ করতে হবে। সার্বিকভাবে বলা যায়, পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে এবং সেখানকার কৃষকদের জীবন ও জীবিকায় সূচনা হবে এক নতুন অধ্যায়ের।

অধ্যাপক, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০