মোহাম্মদ আবু নোমান: আমরা সফল! রচিত হলো আরেকটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। স্বপ্ন হলো সত্যি! এবার বিশ্বের অন্যতম ভয়ঙ্কর খরস্রোত প্রমত্তা পদ্মার ওপর নির্মিত ‘পদ্মা ব্রিজ’ নিয়ে মহাকাব্য লেখার পালা। জীবনের স্মরণীয় স্বল্প কিছু ঐতিহাসিক দিন ও মুহূর্ত থাকে, যা মনের মধ্যে বিশেষ অনুভূতি সঞ্চারিত করে; আর সেই কাহিনীকর ও মর্যাদার মুহূর্তটি তাৎপর্যের কারণেই চির অমলিন থেকে যায়। তেমনই জাতির সাহস আর সামর্থ্যরে প্রতীক, গত ২৫ জুন উদ্বোধনের মাধ্যমে, বহুল প্রতীক্ষিত বিশ্বের অন্যতম খরস্রোত প্রমত্তা পদ্মা জয়ের গল্পের যবনিকাপাত হলো, যা গোটা জাতির জীবনে এক অনন্য উচ্চতা ও গৌরবের অনুভূতি। কারণ, দেশের অসচ্ছল, সুখস্বাচ্ছন্দ্যবঞ্চিত ও সাধারণ জনগণের কষ্টার্জিত প্রায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার বিনিয়োগে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে নির্মিত পদ্মা সেতু। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থে নির্মাণকৃত দেশ হিসেবে সফলতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। যা দেশ ও জাতির জন্য এক অসামান্য সাফল্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এর সফল নির্মাণ ও উদ্বোধনের মাধ্যমে আমরা পৌঁছে গেছি গৌরবের অনন্য উচ্চতায়। দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলার পর, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্ভীক সংকল্পের বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে মর্যাদার জায়গায় তুলে ধরেছেন। দেশকে বসিয়েছেন হিমালয়ের চূড়ায়।
‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ কবি কুসুমকুমারী দাশ আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেখতে পেলে হয়তো তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যেতেন। খ্যাতিমান মহাকাশ বিজ্ঞানী ও ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম বলতেন- ‘সেটা স্বপ্ন নয়, যা ঘুমিয়ে দেখ; বরং সেটাই স্বপ্ন যা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না।’ দুর্নীতির ভিত্তিহীন, অভিযোগের জেরে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের এ অন্যায় সিদ্ধান্তে ঘুম হারাম হয়ে যায় দেশরতœ শেখ হাসিনার। বহুমাত্রিক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও জটিল রকমের প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে দেশের অর্থেই নির্মাণের দৃঢ় সংকল্প করেন শেখ হাসিনা।
মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রী আরজুমান্দ বানুর (যিনি মমতাজ মহল নামে পরিচিত) ভালোবাসা ও স্মরণে ২২ বছর ধরে (১৬৩২-৫৩ খ্রিষ্টাব্দ) ২০ হাজার শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি করেছিলেন ঐতিহাসিক ‘তাজমহল’। তাহলে বিশ্বের অন্যতম ভয়ঙ্কর খরস্রোত প্রমত্তা নদী পদ্মা সেতুর বিশাল কর্মযজ্ঞ কতটা চ্যালেঞ্জের তা বলে বা লিখে শেষ করার মতো নয়।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা, যাকে বলতেই হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অলীক স্বপ্ন। সমালোচকরা বলেছেনও এটা শেখ হাসিনার খেয়ালী, অবাস্তব, ভাববিলাসী ও কাল্পনিক স্বপ্ন! অথচ শেখ হাসিনার অদম্য আত্মবিশ্বাস ও দূরদর্শী পরিকল্পনায় এবং বাঙালি জাতির দুর্দমনীয় প্রচেষ্টায় পদ্মা সেতু নির্মাণ আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে। পদ্মা সেতু শুধু একটি অবকাঠামো নয়, এটা দেশের সক্ষমতার প্রতীক, আত্মমর্যাদার প্রতীক। আমাদের অহংকার ও গৌরবের প্রতীক। আত্মমর্যাদা সম্পন্ন বাঙালির গর্বের আরেকটা নতুন সংযোজন পদ্মা সেতু।
দিনের পর দিন পদ্মা সেতুর কল্পিত দুর্নীতিসংবলিত মনগড়া গল্প-কাহিনী কম হয়নি। সরকার কোনো পদক্ষেপ না নিলে মনে হবে সরকার দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করতে চাচ্ছে। বাধ্য হয়ে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল যদিও দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পায়নি। মন্ত্রী আবুল হোসেনকে ইস্তফা, সচিব মোশারফ হোসেন ভুঁইয়াকে বদলি, প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামকে অপসারণ, দুদকের অনুসন্ধান টিম গঠন, পরে সাতজনের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা, যে মামলায় সচিব মোশারফ হোসেন গ্রেপ্তার ও জেল খাটেন। সর্বশেষ এসব কল্পিত গল্প উড়িয়ে দিয়ে পাঁচ বছরের বেশি সময়ের বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে কানাডার আদালত বলেছে, ‘এই মামলায় যেসব তথ্য দেয়া হয়েছে, তা অনুমানভিত্তিক, গালগল্প এবং গুজবের বেশি কিছু নয়।’
আমাদের চিরচেনা পথ পদ্মা পারের মাওয়া-কাঠালবাড়ী ফেরিঘাটে উদাস বা ভাবুক হয়ে যাওয়ার মতো অবিশ্বাস্য যেসব দৃশ্য ও স্মৃতি রয়েছে, যা কখনও ভুলে যাওয়ার নয়। আসলেই পদ্মা নদীর সঙ্গে ফেরি, লঞ্চ পারাপারে দীর্ঘ প্রতিক্ষা, অ্যাডভেঞ্চার সবই আজ গল্প হয়ে থাকল পরবর্তী প্রজšে§র কাছে। ফেরিঘাটে একটু চা খাওয়া, তারপরে আবার ভোঁ দৌড়ে ফেরি বা লঞ্চে ওঠার মধ্যে একটা থ্রিল ছিল। আমরা সেটাকে দারুণ মিস করব। স্মৃতিতে অম্লান হয়ে থাকবে মাওয়া-কাঠালবাড়ী ফেরি, লঞ্চ ও স্পিডবোটে পারাপারের অন্য এক অভিযাত্রার স্মৃতি। গল্প হয়ে থাকবে, ঘুরে ফিরে আসবে আমাদের দুঃখ, সুখ, বেদনার ও তিক্ত অভিজ্ঞতার নানান কাহিনী। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজš§কে বলব, ‘ওইতো, ওই খান দিয়েই আমরা পার হতাম উত্তাল প্রমত্তা পদ্মা নদী।’
ফেরিঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কখনো দিনভর বসে থাকা স্মৃতি হয়ে থাকবে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, কখনও ঘন কুয়াশা, কখনও প্রচণ্ড খরতাপে, কখনও তেজস্বী, ক্ষিপ্তবৎ ঝড় বৃষ্টিস্নাত রাতে ঝুঁকিপূর্ণ পারাপারের মধ্যেও একটা অ্যাডভেঞ্চার ছিল। ফেরিঘাটে গরম-গরম ডিম সিদ্ধ, ঝালমুড়ি, চা গরম, নারিকেলের চিড়া ভাজা, ফেরিতে অথবা লঞ্চে ইলিশ মাছ, ভর্তা, যত পারো পেটচুক্তিতে ভাত খাওয়া সব হারিয়ে যাবে। দ্রুতগামী ট্রেনে বা বিলাসী গাড়িতে সাঁই সাঁই করে পদ্মা ব্রিজ পার হওয়ার সময় এসব স্মৃতি রোমন্থন ও মনে আসলে মনটা কারওরই খারাপ না হয়ে পারে না। তার পরেও পদ্মা ব্রিজ, এক্সপ্রেসওয়ে ও ভাঙ্গা ফ্লাইওভার প্রাপ্তিতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নপূরণে সৌভাগ্যবান।
এর চেয়ে আর কী পাওয়ার আছে? আর কত আনন্দ হতে পারে? দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের উৎপাদিত কৃষি ও শিল্পজাত পণ্য সহজে ও দ্রুত সময়ে ঢাকা ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতে কৃষকরা উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবেন। কৃষি উৎপাদন বাড়বে। এ অঞ্চলে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার যাবে। ফলে নতুন শিল্পকারখানা তৈরি হবে। বাণিজ্য কেন্দ্র বৃদ্ধি পাবে। মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। মোংলা বন্দর ও পায়রা বন্দর দিয়ে পণ্য আনা-নেয়া সহজ হবে। বন্দরকেন্দ্রিক শিল্প ও বাণিজ্য কেন্দ্র তৈরি হবে। অর্থনীতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে। পদ্মা সেতু এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে। মোটা কথা, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস আর অর্জনের এক অনন্য বার্তা।
পদ্মা সেতু শুধু একটি স্থাপনা নয়; এটি এখন বাঙালি জাতি তথা বাংলাদেশের গর্ব, আত্মমর্যাদা ও অহংকারের প্রতীক। এই সেতু নির্মাণের ফলে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নদীবেষ্টিত ভূখণ্ড সরাসরি রাজধানীর সঙ্গে সংযুক্ত হলো। পদ্মা সেতু যেমন দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের প্রায় ৫ কোটি মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক সুবাতাস বয়ে আনবে, তেমনি কমপক্ষে ১ দশমিক ৫ শতাংশ জাতীয় আয় বৃদ্ধিও নিশ্চিত করবে। ফলে লাভবান হবে পুরো দেশের মানুষ। প্রসার হবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটনের।
অনেক বাধা, অর্থের সংস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তা, দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রস্তাব বাতিল, এসবের পাশাপাশি ছিল প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জও। বিশ্বের অন্যতম খরস্রোত প্রমত্তা নদী পদ্মা এবং এই নদীর তলদেশে মাটির স্তরের গঠনে ছিল নানা রূপ, ছিল নানা জটিলতা। কয়েকটি পাইলিংয়ের গভীরতা বেশি থাকায় জার্মানি থেকে আনতে হয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় ৩ হাজার কিলোজুল শক্তিসম্পন্ন ৩৮০ টন ওজনের হ্যামার। নির্মাণকাজের প্রতিটি পর্বেই কোনো না কোনো চ্যালেঞ্জ এসেছে। এখানে নদীশাসন যেমনটা চ্যালেঞ্জিং ছিল, তেমনি নদীর তলদেশে শক্ত মাটি ও পাথর না থাকায় পাইলিং করাটাও বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ তার কন্যা সেই কথাই প্রমাণ করেছেন। শেখ হাসিনা ওয়াজেদ পদ্মা সেতু নির্মাণের বিশাল চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন এবং জয়ী হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইস্পাত কঠিন মনোবল নিয়ে এদেশের সার্বিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির চাকাকে অধিকতর সচল রাখতে বিরামহীন কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করে চলেছেন। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য তিনি সম্ভাব্য সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে যাচ্ছেন; সুনিপুণ দক্ষতার সঙ্গে একের পর এক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। একই সঙ্গে এটি শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোবল, সাহসিকতা ও সক্ষমতার পরিচায়ক। পদ্মা সেতু ছাড়াও এ বছরই আরও দু’টি মেগা প্রজেক্ট প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন। তা হলো, কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল এবং এমআরটি-৬ প্রকল্পের আওতায় মেট্রোরেল।
পদ্মা সেতুর মাধ্যমে অর্থনীতিতে সরাসরি সুবিধার মধ্যে অন্যতম হলো, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। এতে ওই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তার লাভ করবে। বিনিয়োগ বাড়বে। কৃষক সরাসরি উপকৃত হবেন। তাদের উৎপাদিত পচনশীল পণ্য সরাসরি ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে পাঠাতে পারবেন। এতে পণ্যের ভালো দাম পাওয়া যাবে। এ সেতুর ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার হবে। বিশেষ করে আমদানি-রপ্তানি বাড়াতে মোংলা বন্দর ব্যবহার করা যাবে।
পদ্মা সেতু আমাদের গর্বের সম্পদ, অহংকারের নিদর্শন। এ সেতু আমাদের মর্যাদার প্রতীক, আত্মসম্মানের প্রতীক, কারও কাছে মাথা নত না করে মাথা উঁচু করার প্রতীক, সক্ষমতার প্রতীক, উন্নয়নের প্রতীক এবং সর্বোপরি আমরা পারি তা প্রমাণের প্রতীক। আর এ প্রতীক রচনার বীর ও সাহসী নায়ক শেখ কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
সাংবাদিক
abunoman1972@gmail.com