শামসুন নাহার: বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ ধীরুভাইয়ের প্রশ্নাতীত বৈশিষ্ট্যকেও প্রশ্নবিদ্ধ করল। এ অভিযোগের বোমা বিস্ফোরিত হয় ১৯৯৬ সালের শেষার্ধে। কিন্তু এটি অন্তত এক দশকব্যাপী কর্মকাণ্ডের ফল। আর এর শিকড় ছড়িয়েছে তিন বছরের বেশি সময় ধরে। ধীরুভাই ও রিলায়ান্স অর্থবাজারের বেশ কিছু বড় খেলোয়াড়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তারাই আবার ১৯৯২ সালে বোম্বে সিকিউরিটিজ স্ক্যান্ডালের ফলে শেয়ারবাজার পতনের পেছনে কলকাঠি নেড়েছিলেন।
এ চর্চায় জড়িত দালাল ও ব্যাংকারদের মতে, এটা শুরু হয় ১৯৮৪-৮৫ সালে, যখন পাবলিক সেক্টরের কিছু ব্যাংক কংগ্রেসের পক্ষে রাজীব গান্ধীর নির্বাচনি তহবিল জড়ো করার কাজ করে। প্রায় ৪০০ কোটি রুপির তহবিল গড়া হয় এভাবে। কংগ্রেসের মদদপুষ্ট হওয়ায় দালালদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় এবং তারা এ বেহিসাবি অর্থায়নের খেলায় মেতে ওঠে আরও বড় পরিসরে।
প্রকৃত সিকিউরিটি দাখিল না করেই ব্যাংকার্স রিসিপ্ট বা বিআর প্রদান করা হচ্ছিল। রিজার্ভ ব্যাংকও অবগত ছিল এ ব্যাপারে। কিন্তু এ বিষয়ে তারা উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত আরবিআই’র ডেপুটি গভর্নর এবং ব্যাংকিং অপারেশনের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অমিতাভ ঘোষ। অমিতাভের দ্বিতীয় টার্মে আরও পাঁচ বছরের জন্য ডেপুটি গভর্নর পদ পাওয়ার ক্ষেত্রেও ধীরুভাইয়ের হাত ছিল বলে মনে করেন অনেকে। বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। পরে একটি যুগ্ম সংসদীয় কমিটির রিপোর্টে দায়িত্বকে হালকাভাবে নেওয়ার কারণে ঘোষের নিন্দা করা হয়।
১৯৮০’র দশকের শেষাংশে পাবলিক সেক্টর এন্টারপ্রাইজের আবির্ভাবের কারণে নথিবহির্ভূত বাজারের গতি বৃদ্ধি পায়। বেশি পরিমাণে উদ্যোক্তা তৈরিই ছিল এ নীতির মূল সুর। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত ঋণের মেয়াদ ছিল এক বছর। এর ফলে কিছু কিছু এন্টারপ্রাইজ অনুমোদনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাদের বন্ড ইস্যু করা শুরু করে। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই যে বিনিয়োগ প্রোগ্রামকে লক্ষ্য করে এ তহবিল সংগ্রহ করা হয়েছে, তা দীর্ঘসূত্রতার সম্মুখীন হতে থাকে। এ বন্ডের অল্প কিছু অংশই আমজনতার হাতে পৌঁছায়। বেশিরভাগই ওই সব ব্যাংকের দখলে যায়, যাদের ব্যাংক রিজার্ভের জন্য সরকার কর্তৃক অনুমোদিত সিকিউরিটির। ফলে ব্যাংকের হাতে জমে যায় স্বল্প সুদহারের কাগজ, অন্যদিকে উদ্যোক্তারা পান বাড়তি নগদ অর্থ। আর এ দুই পক্ষেরই বন্ডের সুদহার থেকে লাভবান হওয়া দরকার ছিল।
এমন পরিস্থিতিতে আবির্ভাব ঘটে পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট স্কিমের। এর মূলমন্ত্র হচ্ছে, এন্টারপ্রাইজ ও প্রাইভেট সেক্টর কোম্পানিগুলো তাদের অতিরিক্ত তরল অর্থ ব্যাংককে ঋণ হিসেবে দেবে, যা আমানত হিসেবে গণ্য হবে না। বরং বিনিয়োগের মর্যাদা পাবে। এ ব্যবস্থায় প্রদত্ত অর্থ ফেরতের কোনো নিশ্চয়তা থাকবে না। ফলে ঝুঁকি বর্তাবে এন্টারপ্রাইজের ওপর, ব্যাংকের ওপর নয়। লেনদেনের এ নতুন ধারার কারণে ব্যাংকার ও দালালদের মধ্যে একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এছাড়া ব্যাংকারদের শেয়ারবাজারে উচ্চ ঝুঁকির বিনিয়োগের অনুমতি ছিল না। তাই শেয়ার মার্কেটে লেনদেনের উদ্দেশ্যে নতুন এক উপায় বের করল তারা। ব্যাংকাররা দালালদের নামে ব্যাংকার্স রিসিপ্ট প্রদান করা শুরু করল। আর দালালরাও কোনো প্রকৃত সিকিউরিটি দাখিল করা ছাড়াই এর মালিকানা পেয়ে গেল। এ ব্যবস্থাকেই বলা হতো ‘রেপো সিস্টেম’।
ধীরুভাই ১৯৮০’র দশকের শেষের দিকে অর্থবাজারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৯৮৬-৮৭ সালে হারানো রিলায়ান্স শেয়ারের মূল্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে। ধীরুভাই তার তহবিল সংগ্রহের কর্মকাণ্ডকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে গেলেন যে অনেকে একে একধরনের ভার্চুয়াল ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এর গুরুত্ব অনেকটা তার পলিয়েস্টার ব্যবসায়ের সমান হয়ে উঠল।
১৯৯২ সালের রেপো বুমের সময় সবচেয়ে আলোচিত নাম ছিল মেহতাদের। হরষাদ মেহতা ও তার ভাইয়েরা ১৯৮৬ সালে শেয়ারবাজারে রিলায়ান্সের শেয়ার-মূল্যের অবমূল্যায়নের অভিযোগে জড়িয়ে পড়েন। এ স্কিমের কৌশল ফেঁদেছিলেন আম্বানির তৃতীয় ছেলে বলে খ্যাত আনন্দ জাইন। যাহোক, মেহতাদের এক ভাই ক্রেডিট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব ইন্ডিয়ার ভাইস চেয়ারম্যানের মেয়েকে বিয়ে করেন। এ পারিবারিক সম্পর্ককে ব্যবসায়ের স্বার্থে সফলভাবেই ব্যবহার করেছিলেন তারা। হরষাদ মেহতার ভাইয়ের শ্বশুর আবার রিলায়ান্সের একজন বড় ঋণদাতা। ফলে মেহতারা এ সংকট থেকে অল্পেই বেঁচে যান। এর পর থেকে রিলায়ান্সকে এড়িয়ে চলা শুরু করেন তারা। মনোনিবেশ করে অর্থবাজারে। ১৯৯০ সালে মেহতারা আবার শেয়ারবাজারে ঢোকার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৯১ সালের মধ্যে আবার তারা নিজেদের নাম নতুন করে পরিচিত করে ফেলেন। তাদের এ পুনরাগমন খুবই সাড়া জাগায়। লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে শুধু তাদের একক আগ্রহই শেয়ারবাজারের সূচককে ঊর্ধ্বগতি দিতে যথেষ্ট।
১৯৯১ সালের নভেম্বর মাসে মেহতাদের পক্ষ থেকে আম্বানিদের কাছে একটি ফোন করা হয়। তাদের এ সাক্ষাতে ১৯৮৬ সালের ঘটনা উঠে আসে বটে। কিন্তু অতীতকে ভুলে সামনে এগিয়ে যেতে চান তারা। তাদের সম্পর্কের ব্যাপক উন্নতি হতে থাকে। দেখা-সাক্ষাতের মাত্রাও বাড়তে থাকে। রিলায়ান্সের তখন এর শেয়ারমূল্য বাড়ানোর খুব দরকার ছিল। দীর্ঘকাল ধরেই ১৩০ থেকে ১৭০ রুপির মধ্যেই ঘোরাফেরা করছিল রিলায়ান্স শেয়ারদর। নিমেষ শাহের মতো ঝানু স্টকব্রোকারকে কাজে লাগিয়েও এ অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। রিলায়ান্সের তখন লক্ষ্য হলো, ভারতের প্রথম কোম্পানি হিসেবে ইউরো-ইস্যুর অধিকারী হওয়া এবং উচ্চ মূল্যে সেই শেয়ার বাজারে বিক্রি করা।
মেহতারা দেখলেন যে এখনও অনেকেই এটাই বিশ্বাস করে যে রিলায়ান্স নিজের শেয়ার নিজেই বিক্রি করে থাকে। তারা রিলায়ান্সের শেয়ার নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু শর্ত ছিল নিজের শেয়ার নিজে বিক্রি করতে পারবে না রিলায়ান্স। রিলায়ান্স শর্তে রাজি হলো। মেহতারাও শুরু করলেন কাজ। ফলে ১৯৯২ সালের শুরুতে যে শেয়ারের মূল্য ছিল মাত্র ১২৭ রুপি, তার মূল্য ফেব্রুয়ারির শেষে গিয়ে হলো ২৪১ রুপি, আর মার্চের শেষে হলো ৪৫৫ রুপি। পাশাপাশি সেনসেক্স সূচকের মান যা ১৯৯১ ডিসেম্বরের শেষে ছিল মাত্র ১৯১৫, তা ২২ এপ্রিল গিয়ে দাঁড়াল ৪৪৬৭-তে। ফলে রিলায়ান্সের শেয়ারের ঊর্ধ্বগতি মেহতারাই যে অন্যতম প্রভাবক হয়ে কাজ করেছেনÑতা অনুমান করতে স্বাভাবিকভাবেই কারও কোনো কষ্ট হয়নি।
এ ঘটনার পর হরষাদ মেহতা শেয়ারবাজারের সেলিব্রিটি বনে গেলেন। তার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য রিপোর্টারদের ভিড় পড়ে গেল। সবাই জানতে চায় কী এমন কৌশল খাটিয়েছেন তিনি। এ স্কিমের ফলে মেহতাদের হাতে যে বিপুল অর্থ এসেছিল, তা নিয়ে কেউ কোনো বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবই প্রকাশ করেনি। ভারতের সবচেয়ে বড় করদাতা হিসেবে পুরস্কৃৃতও করা হলো তাকে। উপাধি দেওয়া হলো দ্য বিগ বুল। অনেকে আবার মেহতাকে ডাকলেন ‘দ্বিতীয় আম্বানি’ বলে।
এতে হয়তো একটু রুষ্টই হয়েছিল আম্বানি পরিবার। রিলায়ান্সের শেয়ার নিয়ে কাজ করে একজন সামান্য দালাল এত বাহবা পাচ্ছে এটা তাদের ভালো লাগেনি। এছাড়া মেহতার কৌশল যে আম্বানির পন্থার চেয়ে বেশি ফলপ্রসূ হয়ে গেল, তাও মানতে পারেননি তারা। রিলায়ান্স পেট্রোকেমিক্যাল ও লার্সেন অ্যান্ড টুবরো নিয়ে রিলায়ান্স তখন চাপে ছিল। এ দুই কোম্পানির যে ডিবেঞ্চারগুলো বিক্রি করছিল রিলায়ান্স, সেগুলোই কিনে নিচ্ছিলেন মেহতা। বিশেষত রিলায়ান্স পেট্রোকেমিক্যালের ডিবেঞ্চার কিনে খুব লাভ করেছে তারা। রূপান্তরের পর অল্প দরে শেয়ার পাওয়া গেছে। এছাড়া ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরেও ট্রিপল ডিবেঞ্চার ইস্যুর সময়ও অনেক পরিমাণে কিনেছেন মেহতারা। ফলে তাদের হাতে জমা পড়েছে রিলায়ান্স শেয়ারের উল্লেখযোগ্য অংশ। এরপর এ শেয়ার নিয়ে নিজেদের মতো করে ব্যবসা করতে লাগলেন মেহতা। অর্থাৎ রিলায়ান্সের শেয়ার দিয়ে নিজেদের কৌশলের গুণে রিলায়ান্সের চেয়েও বেশি লাভজনক ব্যবসা করছিলেন মেহতারা।