পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যান সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। মাত্র ১০০ টাকা বেতনে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। পাশাপাশি নাইট কলেজে উচ্চতর পড়াশোনা চালিয়ে যান। স্বাধীনতার পর এক হাজার ৪২৬ টাকা দিয়ে শুরু করেন ট্রেডিং ব্যবসা। এরপর উৎপাদন খাতে কারখানা গড়ে তোলেন। অনেকটা শূন্য থেকে শুরু করা মানুষটি আজ ব্যবসায়িক জগতে সফল এক কিংবদন্তি। তার সাফল্যের তালিকায় আরেকটি অর্জন ‘একুশে পদক’। তিনি এ স্বর্ণশিখরে এসে শোনালেন নিজের চড়াই-উৎরাইয়ের নানা গল্প। নিজ কার্যালয়ে শেয়ার বিজের সঙ্গে আলাপচারিতায় বললেন বলা-না বলা সব স্বপ্ন ও সম্ভাবনার কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফুল আলম
শেয়ার বিজ: আপনার সাফল্যের ঝুলিতে আরেকটি অর্জন হলো এ বছর সমাজসেবায় একুশে পদকের জন্য মনোনীত। দেশের দ্বিতীয় ব্যবসায়ী হিসেবে আপনি এ পদক পাচ্ছেন। এতে আপনার অনুভূতি কী?
মিজানুর রহমান: আমি ১০০ টাকার মানুষ থেকে আজকের এ অবস্থানে এসেছি। এটি মহান সৃষ্টিকর্তার রহমত। আমি এ রাষ্ট্রীয় সম্মানের জন্য যোগ্য নই। তবুও প্রধানমন্ত্রী দয়া করে এটি আমাকে দিয়েছেন। আমি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। আর এ পুরস্কার অর্জনের ফলে রাষ্ট্রের প্রতি আমার ও আমার পরিবারের দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে। এ দেশের মানুষ এত বুদ্ধিমান, দক্ষ, কর্মঠ, যা আর কোথাও নেই। এ মানুষগুলোকে কেবল সুযোগ দেওয়া দরকার। দরকার আনন্দ-উৎসাহ ও সুন্দর একটি পরিবেশ দেওয়া। তারা কেন অনাহার-অনাদরে, বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে। তাদের জন্য আরও কিছু করতে চাই।
শেয়ার বিজ: পিএইচপি পরিবারের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলুন…
মিজানুর রহমান: বর্তমানে পিএইচপি ফ্যামিলির অধীনে ৩১টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১৩ হাজার কর্মী কাজ করছেন। এর মধ্যে চলতি বছরের শুরুতে সীতাকুণ্ডের গ্লাস ফ্যাক্টরির উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। আগে এ কারখানার উৎপাদন ছিল প্রতিদিন ১৫০ টন, যা বর্তমানে হচ্ছে ৩০০ টন। এছাড়া সম্প্রতি ফেনীর ছাগলনাইয়ায় সিআই শিট ফ্যাক্টরির দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে এসেছে। যদিও গত ২৬ জানুয়ারিতে কারখানাটির প্রথম ইউনিট চালু হয় এবং আগামী ২০ তারিখে তৃতীয় ইউনিট চালু হবে। এছাড়া ঢাকার
বারিধারায় আমাদের ইউআইটিএসের নিজস্ব স্থায়ী ক্যাম্পাস হয়েছে। আমাদের শিপইয়ার্ড বিশ্বের ২০টি গ্রিন শিপইয়ার্ডের একটি। এ ধরনের শিপইয়ার্ড এশিয়ায় নেই। আমরা এমন শিল্প স্থাপন করব না কিংবা করিনি, যেখানে মানুষের ক্ষতি হয়। এক্ষেত্রে আমরা অনেক সচেতন।
শেয়ার বিজ: ব্যাংকার থেকে ব্যবসায়ী হলেন কেন?
মিজানুর রহমান: আমি ছোটবেলা থেকে বাসার কাজ করতাম। নিজে হাল চাষ, মাছ চাষসহ সব কাজ করতাম। আর স্কুলজীবন মোটামুটি শেষ হলেও কলেজ জীবনই ছিল কষ্টের। সারা দিন কাজ করতাম। আর সন্ধ্যায় নাইট কলেজে গিয়ে রাত ১১টা পর্যন্ত ক্লাস করতাম। কেবল তা-ই নয়, চার মাইল হেঁটে বাড়ি ফিরে রাতের খাবার রান্না করে খেয়ে রাত আড়াইটায় ঘুমাতে যেতাম। আবার সকাল ৮টা থেকে অফিস। কাজের ফাঁকে ফাঁকেই টিউশনি ও নিজের লেখাপড়া করি। ইন্টারমিডিয়েট পাসের পরপরই ১৯৬৫ সালে সর্বপ্রথম তৎকালীন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে (বর্তমানে সোনালী ব্যাংক লিমিটেড) চাকরি নিয়ে চট্টগ্রামে আসি। সেখানে দুবছর চাকরি করার পর ৬৭ সালেই আরেকটি ব্যাংকে যোগ দিই। তবে স্বাধীনতার পরপরই চাকরি ছেড়ে দিই। তখন ব্যবসার জন্য মূলধন ছিল মাত্র এক হাজার ৪৮৩ টাকা। এ মামুলি টাকা দিয়েই ব্যবসা শুরু করি। তখন বাংলাদেশে ব্যবসায়ীর সংখ্যা অনেক কম ছিল। কেননা, বেশিরভাগ ব্যবসায়ীই ছিলেন অবাঙালি। তৎকালীন আদমজি, বাওয়ানি, দাউদের মতো বড় ব্যবসায়ীরা স্বাধীনতার পর যখন নিজ নিজ দেশে ফিরে যান, তখন ব্যবসা ক্ষেত্রে বিশাল এক শূন্যতা তৈরি হলো। ঠিক এ সময়টাকে কাজে লাগাই এবং বেশ কবছর ব্যাংকে কাজের অভিজ্ঞতা থাকায় এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসায় নেমে পড়ি। নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখতাম কোন দেশে কোন জিনিস তৈরি হয়, কোন দেশের ভালো জিনিস কম দামে পাওয়া যায়; আবার নিজের দেশে কোন সিজনে কোন জিনিস ভালো দামে বিক্রি হয়।
প্রথম দিকে টায়ার-টিউব, মিল্ক পাউডার, সুতা, পুরোনো কাপড়, স্পেয়ার পার্টস, মোটর পার্টস প্রভৃতি আমদানি করি। পরে আস্তে আস্তে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের দিকে মনোযোগী হই। মহান আল্লাহ সহায় ছিলেন বলে আমি এত কিছু করি। আসলে মূল কথা হলো, নিজের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস রাখতে হবে। আল্লাহর প্রতি অনুগত হতে হবে। ধর্মীয় বিধিবিমান মানতে হবে।
শেয়ার বিজ: কী হওয়ার স্বপ্ন ছিল, আর কী হলেন?
মিজানুর রহমান: স্বপ্ন তো ছিল অনেক কিছু হওয়ার। এখনও প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখি। আমি এখন সোনার মানুষ খুঁজি। যারা হবেন জ্ঞানী, বিদ্বান, সৎ, দয়ালু। বলতে পারেন, আমি ব্যবসা ক্ষেত্রে সফল; তারপরও কিছু আকুতি থেকে গেছে। আমরা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেকটা অবদান রাখতে পেরেছি। বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি, যা আমাদের আগে আর কেউ নিতে পারেনি। কিন্তু এখনও কিছু স্বপ্ন পূরণ বাকি আছে। যার একটি হলো, বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেসিক স্টিল মিলস মেকার হিসেবে দেখতে চাই।
শেয়ার বিজ: আপনি একজন সফল বিনিয়োগকারী। শিল্প খাতের নানা ক্ষেত্রে আপনি সফল হয়েছেন। আর কোন কোন খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ আছে?
মিজানুর রহমান: এখনও এগিয়ে যাওয়ার অনেক সম্ভাবনা আছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণে ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। এ রকম আমাকে ৩০ হাজার কোটি টাকা দিন। আমি দেশের সবচেয়ে বড় স্টিল মিল স্থাপনের মাধ্যমে ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান করে দেব। এ ধরনের একটি স্টিল মিল স্থাপনের স্বপ্ন নিয়ে আমরা মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে কাজ করছি। এটাই আমার নেক্সট টার্গেট। দোয়া করবেন। ভালো কিছু করব। মনে রাখা জরুরি, মন থেকে চাইলে সবকিছুই সম্ভব।
শেয়ার বিজ: বর্তমানে দেশের অর্থ–বাণিজ্যের পরিবেশ কেমন? একজন ব্যবসায়ী কেমন নীতিগত সহায়তা চান?
মিজানুর রহমান: সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অর্থনীতি কিছুটা মন্দা যাচ্ছে। ব্যাংক খাতে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা মন্দা ঋণ। উৎপাদন খাতে অনেকটা ধীরগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। পোশাক খাতেও রফতানি আয় নেতিবাচক ধারায় লক্ষ করা যাচ্ছে। এর মধ্যে চীনে চলছে প্রাণঘাতি করোনাভাইরাস। ফলে তাদের সব ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ আছে। আর এভাবে আগামী কিছুদিন চলতে থাকলে চীনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্পগুলো ভয়াবহ সংকটে পড়বে। এছাড়া বর্তমানে আগাম শুল্ককর, অর্থাৎ এআইটি নিয়ে ব্যবসায়ীরা বেশ বেকায়দায়। আমি যদি বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকা কাঁচামাল আমদানি করি, সেখানে ৩৫০ কোটি টাকা আগাম শুল্ককর দিতে হয়। কিন্তু এ টাকা তো দ্রুত সমন্বয় কিংবা পাওয়া যায় না, যা ব্যবসায় নগদ প্রবাহে সমস্যা তৈরি করে। এগুলো বিবেচনা করতে হবে। আরও ব্যবসাবান্ধব হতে হবে। এতে আরও উন্নয়ন হবে।
শেয়ার বিজ: অনেকটা শূন্য থেকে আপনি ক্যারিয়ার শুরু করেছেন। দেশের জনগণের কাছে বড় শিল্পপরিবার হিসেবে পিএইচপি ফ্যামিলির সুনাম আছে। আর বিপুলসংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠী চাকরির জন্য নানা স্থানে ছুটে বেড়াচ্ছে। কেউ হচ্ছে হতাশ, আবার কেউ উদ্যোক্তা। এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?
মিজানুর রহমান: তরুণদের উচিত চাকরির জন্য নয়, নিজে চাকরি দিতে পারেÑএমন কিছু করা। তাদের বড় হতে হলে অবশ্যই যে কোনো কাজ করার মানসিকতা থাকতে হবে। এমনকি বাড়ির পাশে সবজি চাষ, হাঁস-মুরগি পালন শুরু করতে পারে। এগুলো করে বছরে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা আয় করা যায়। মনে রাখতে হবে, তিন দিনে তো বড় ব্যবসায়ী হওয়া যাবে না। আমি সুফি মিজানুর রহমান ৭৭ বছর ধরে পরিশ্রম করছি। শুধু বড় বড় স্বপ্ন দেখলেই হবে না। স্বপ্ন পূরণে কঠিন পরিশ্রম ও তপস্যা করতে হবে। জ্ঞানতাপস সক্রেটিস বলেছিলেন, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মানুষ কে? আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কিংবা শ্রেষ্ঠ কাজ কোনটি? প্রত্যুত্তরে সক্রেটিস বলেন, ‘এ মুহূর্তে তুমি যে কাজটি করছো, সেটিই তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। এ মুহূর্তে তুমি যার সামনে আছ, তিনি তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মানুষ। আর মানুষের জন্য কিছু করা তোমার শ্রেষ্ঠ কাজ।’ সক্রেটিসের এ কথা যদি কেউ মেনে চলতে পারেন, তবেই না একজন সত্যিকারের মানুষ হতে পারবেন। মনে রাখতে হবে, সময়ের অপব্যবহার ও অপচয় করা যাবে না। আগে তরুণদের একজন ভালো মানুষ হতে হবে। পরোপকারী হতে হবে। হতে হবে সৎ, পরিশ্রমী ও দেশপ্রেমিক। তবে তা কাউকে দেখানো কিংবা বাহবা পাওয়ার জন্য নয়, মনের গভীর আকুতি থেকে। আমি তো একুশে পদক পাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করিনি।
শেয়ার বিজ: একজন ভালো ব্যবসায়ীর গুণাবলি কেমন হওয়া উচিত?
মিজানুর রহমান: রাতারাতি বড় হওয়ার চিন্তা করা যাবে না। মানুষ ঠকানো যাবে না। অনেকেই টাকার জন্য ‘ইয়াবা’ ব্যবসা করেন। মনে রাখতে হবে, টাকাই জীবনের সবকিছু নয়। টাকা দিয়ে বই কেনা যায়, কিন্তু মেধা কেনা যায় না। টাকা দিয়ে বাড়ি-গাড়ি-সম্পদ কেনা যায়; কিন্তু সুখ কেনা যায় না। অনেক ব্যবসায়ীর ছেলেমেয়ে আছে, যারা শরীরের ভারে হাঁটতে পারে না। অথবা সন্তানরা কি করছে খোঁজ-খবর রাখে না। এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, আজ আমরা সন্তানদের সময় দিই না। তাদের অনুপ্রাণিত বা উজ্জীবিত করতে পারি না। তাদের মনের মধ্যে বড় স্বপ্ন তৈরি করতে আমরা ব্যর্থ হই। ২৪ ঘণ্টা কেবল টাকার জন্য পাগলের মতো ছুটে বেড়াই। স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন কিংবা দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে যে আত্মার সম্পর্ক, তা ভুলে যাই। আবার অনেক সময় দেখা যায়, নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কি হচ্ছে, তাও খবর নেয় না অথবা মাসে একবারও কারখানায় যায় না। এভাবে সবকিছু চলে না।
শেয়ার বিজ: আপনার ইচ্ছা ছিল একটি ক্যানসার হাসপাতাল তৈরি করা। এ বিষয়ে কিছু বলুন…
মিজানুর রহমান: আমি এত ধনী লোক নই। তবে মন আছে অনেক বড়। চেষ্টা আছে। আমার বাবার আমলে ঢাকার কাঞ্চননগর গ্রামে ৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়। সেখানে অল্প টাকায় রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। সে হাসপাতালটিকে সম্প্রসারণ করা হবে। সেখানে আন্তর্জাতিক মানের ক্যানসার সেবা দেওয়ার ইচ্ছা আছে।
শেয়ার বিজ: আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনার সাফল্য ও সমৃদ্ধি কামনা করছি।
মিজানুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ। শেয়ার বিজের সব কর্মকর্তা, কর্মচারী ও পাঠকদের ধন্যবাদ জানাই।