Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 8:41 am

পরিকল্পনা ছাড়াই রফতানির ঘোষণা

নিজস্ব প্রতিবেদক: কয়েক বছর ধরে চামড়ার দাম নিয়ে কারসাজির অভিযোগ উঠছে। সিন্ডিকেটের কারসাজিতে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা, যদিও চামড়ার দাম কমে যাওয়া নিয়ে একে অন্যকে দোষারোপ করছে পাইকার ও ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন। আর এ সিন্ডিকেট বা কারসাজির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই সরকার চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যদিও কীভাবে ও কারা চামড়া রফতানি করবে, রফতানি হলে দেশীয় শিল্প কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ক্ষতি হলে তা কীভাবে পুষিয়ে নেওয়া যাবে তার কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন করেনি সরকার। এ পরিস্থিতিতে শনিবার থেকেই চামড়া কেনার ঘোষণা দিয়েছে ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন, যদিও সিন্ডিকেটের অভিযোগ তারা অস্বীকার করেছে। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, সিন্ডিকেটের কারণে চামড়ার দাম কমে গেছে।
মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার বেশি দামে চামড়া কিনে ক্ষতির মুখে পড়েন ক্ষুদ্র ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। এছাড়া কোরবানিদাতারা চামড়ার দাম না পেয়ে চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেন। নষ্ট হয়ে যায় হাজার হাজার চামড়া। এ নিয়ে ঈদের দিন থেকে গতকাল পর্যন্ত চামড়া নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও দিনাজপুরে রাস্তায় চামড়া ফেলে গেছেন অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী।
চামড়ার দাম কমে যাওয়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। গতকাল রংপুরের শালবন এলাকায় নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের কাছে এ মন্তব্য করেন তিনি। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘চামড়া নিয়ে যখনই ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করি, তখনই তার বিরুদ্ধাচরণ করা হচ্ছে। ঈদের আগে ট্যানারি মালিক ও চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।’
চামড়ার দাম একেবারেই কমে গেছে বলে উল্লেখ করে টিপু মুনশি বলেন, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণেই সরকার কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। যদিও সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা বলছেন।
চামড়া ব্যবসায়ীরা আজ বৈঠক ডেকেছেন বলে জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ব্যবসায়ীদের সিদ্ধান্ত দেখে সরকার পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। টিপু মুনশি আরও বলেন, কোনোভাবেই চামড়াশিল্পকে ধ্বংস করতে দেওয়া যাবে না।
সূত্রমতে, বাংলাদেশে সারা বছর যে-সংখ্যক পশু জবাই হয়, তার অর্ধেক হয় এই কোরবানির মৌসুমে। সরকারি হিসাবে এবারেও প্রায় সোয়া কোটি পশু জবাই করা হয়েছে। কোরবানি যারা দেন, তাদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া কিনে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন পাইকারদের কাছে। পাইকাররা সেই চামড়ায় লবণ দিয়ে সংরক্ষণের প্রাথমিক কাজটি সেরে বিক্রি করেন ট্যানারিতে। এ সময়ই সবচেয়ে বেশি চামড়া সংগ্রহ করেন ট্যানারি মালিকরা। ন্যূনতম কোন দামে তারা সেই চামড়া কিনবেন, তা ঈদের আগে ঠিক করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
যদিও ঈদের দিন বিকাল থেকেই চামড়ার দাম পড়ে যাওয়ার খবর আসতে থাকে। ফড়িয়া আর মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নামমাত্র দামে চামড়া কিনেও পাইকারদের কাছে বিক্রি করতে না পেরে শঙ্কিত হয়ে ওঠেন, কারণ সংগ্রহ করা চামড়া সংরক্ষণের নিজস্ব কোনো ব্যবস্থা তাদের থাকে না।
অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে উত্তরবঙ্গের অন্যতম বৃহৎ চামড়ার বাজার দিনাজপুরের রামনগরে কাঁচা চামড়া বিক্রি করতে না পেরে বাজারে ফেলে চলে যান মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (সিসিসি) জানায়, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা নগরীর বিভিন্ন এলাকায় লাখখানেক পশুর চামড়া সড়কে ফেলে দিয়ে গেছেন, সেগুলো সরিয়ে এখন মাটিতে পুঁতে ফেলতে হচ্ছে।
আড়তদারদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে বকেয়া টাকা না পাওয়ায় অনেকেই চামড়া কিনতে পারেননি। ফলে বাজারে চামড়ার দাম পড়ে গেছে। ট্যানারি মালিকরা পাল্টা অভিযোগ করছেন, আড়তদাররাই সিন্ডিকেট করে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের ঠকাচ্ছেন। এরই মধ্যে বিএনপির তরফ থেকে অভিযোগ করা হয়, কাঁচা চামড়ার দাম নামিয়ে দিয়ে পাশের দেশে পাচার করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে, আর এর পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের এক নেতার সিন্ডিকেট। এমন পরিস্থিতিতে গত মঙ্গলবার বিকালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিবৃতিতে কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত আসে। বিবৃতিতে বলা হয়, উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতি প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে কাঁচা চামড়া ক্রয়-বিক্রয় নিশ্চিত করতে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা কামনা করা হচ্ছে।
অপরদিকে কাঁচা চামড়া রফতানির সুযোগ দিলে দেশের চামড়াশিল্প হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন। গতকাল ধানমণ্ডিতে সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি মো. শাহিন আহমেদ বলেন, কাঁচা চামড়া রফতানি করা হলে চামড়াশিল্প নগরীতে সাত হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়বে। সাভারের আধুনিক চামড়াশিল্প নগরী তখন কাঁচামালের অভাবে অকেজো হয়ে পড়বে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিস্তর মানুষ বেকার হয়ে যাবে।
রফতানির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে শাহিন বলেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত সাময়িক। আমরা সরকার ও জনগণকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই, আগামী ২০ আগস্ট থেকে আমরা সরকার-নির্ধারিত দামেই লবণ দেওয়া চামড়া কেনা শুরু করব। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের বলব, আপনারা লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করুন। ট্যানারিগুলোর কাছে ৩০০ কোটি টাকা বকেয়া থাকার যে অভিযোগ পাইকাররা করছেন, তা অস্বীকার করে শাহিন বলেন, আড়তদারেরা বকেয়া টাকা না পাওয়ার কথা বলে প্রান্তিক মানুষের কাছ থেকে কম দামে চামড়া কিনেছেন। বড় আড়তদাররা এবার চামড়ার বাজারটাকে ম্যানিপিউলেট করেছেন।
অন্যদিকে গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবদুল লতিফ বকসীর সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে অবিলম্বে নির্ধারিত মূল্যে কাঁচা চামড়া কিনতে শুরু করবে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন। কাঁচা চামড়ার গুণাগুণ যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য স্থানীয়ভাবে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চামড়া সংরক্ষণের জন্য চামড়া ব্যবসায়ী ও সংরক্ষণকারীদের প্রতি আগেই অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের অনুরোধ জানিয়েছে। ২০ আগস্টের আগেই জরুরি ভিত্তিতে কাঁচা চামড়া ক্রয় শুরু করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
যদিও রফতানির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান বলেন, সরকারের এ সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। এতে আমরা লাভবান হব। তিনি দাবি করেন, বহু বছরের বকেয়া জমতে জমতে ট্যানারি মালিকদের কাছে তাদের পাওনা হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। গত তিন বছরে এ নিয়ে দেড় ডজন মামলাও হয়েছে। কিন্তু বকেয়া টাকা আদায় করা যায়নি। তাই আমরা বিনিয়োগও করতে পারছি না। এজন্য এবার চামড়ার দাম কম। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে চামড়ার দাম আরও কমে যাবে।
উল্লেখ্য, ঈদের আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, গতবছর কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়ার যে দাম সরকার ঠিক করে দিয়েছিল, এবারও সেটাই রাখা হয়েছে। সে অনুযায়ী ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর কাঁচা চামড়া ৪৫ থেকে ৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় কেনার কথা ট্যানারি ব্যবসায়ীদের। আর খাসির কাঁচা চামড়া সারা দেশে ১৮ থেকে ২০ এবং বকরির চামড়া ১৩ থেকে ১৫ টাকা দরে কেনাবেচা হওয়ার কথা।