পরিবর্তনের সূচনা হোক পরিবার থেকেই

সুরাইয়া:বর্তমান প্রজন্মের কাছে অন্যতম জনপ্রিয় বাংলা কার্টুন হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে মিনা কার্টুন। বাংলায় ডাবিংকৃত মীনা কার্টুনের অমর স্রষ্টা মুস্তফা মনোয়ার। ইউনিসেফের সহায়তায় উনিশ দশকের মেয়েশিশুদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতেই প্রতিবাদী, প্রাণবন্ত চরিত্র মীনা কার্টুনের সৃষ্টি। শিক্ষা যেহেতু জাতি গঠনের মূল কারিগর, তাই শিক্ষাকে হাতিয়ার করেই মেয়েশিশুদের অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসাই এই কার্টুন তৈরির মূল লক্ষ্য। এই কার্টুন দেশগুলোর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ায়, সমাজের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে ১৯৯৮ সাল থেকে প্রতি বছর ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী মীনা দিবস পালিত হয়। তবে মেয়েশিশুদের অন্ধকার থেকে আলোতে আনতে শুধু বছরের একটি দিন নয়, বছরের প্রতিটি দিন মেয়েশিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সজাগ থাকতে হবে। মেয়েশিশুকে তার প্রাপ্য অধিকার দিতে যেন কেউ উদাসীন না হয় সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। আর উনিশ শতকের মেয়েদের কথা বলতে হলে, সেই সময় মেয়েদের একপ্রকার ঘরকুনো হয়েই থাকতে হতো। তারা ঘরের কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরিবারে মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা বেশি কাজ করে; খাবারে ভাগ তাই ছেলেরাই বেশি পাবে। এই ধারণাকে পরিবারের সদস্যরা পুঁজি করায়, পরিবারে অসম খাদ্য বণ্টনের ভাগীদার হতো মেয়েরা। ফলে বোঝা যায়, মেয়েদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পরিবারের সদস্যরা ছিল উদাসীন। আর সেসময়ের মেয়েদের পড়াশোনার কথা তো বলাই বাহুল্য। মেয়েশিশুরা একটু বড় হলেই তাদের ঘর-সংসারের কাজে মন দেওয়া ছিল গুরুদায়িত্ব। এই কাজে পটু হলেই তাদের একমাত্র গন্তব্যস্থল হতো শ্বশুর বাড়ি। শুধু ছেলেরা নয়, মেয়েরাও যে সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে সেই ধ্যান-ধারণা থেকে তারা অনেকটা দূরে ছিল। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এখনও আমাদের গ্রামীণ সমাজগুলোত মেয়েদের এই করুণ অবস্থা চোখে পড়ার মতো। আমাদের সমাজগুলোতে এই সব সামাজিক প্রতিবন্ধকতায় লাগাম টানতেই এই এনিমেটেড সিরিজ তৈরি। কার্টুনের মূল চরিত্র মীনা তার গ্রামের সবাইকে মেয়েশিশুদের অধিকার রক্ষায় সচেতনতা তৈরিতে এগিয়ে আসে। পাশাপাশি মেয়েরাও যে সমাজের তৈরি করা প্রাচীন কুসংস্কারগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রয়োজনীয় ও সমঅধিকার পেলে  অনেক কিছু হতে পারে, সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে তা বোঝানো। এছাড়া মীনা তার নিজের গ্রামে স্কুলের আপা মনির উৎসাহে সমসাময়িক নানা বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন করতে ও তার গ্রামের যেকোনো সমস্যা মোকাবিলায় এগিয়ে আসে। আর এখন শুধু মেয়েশিশু নয়, সব শিশুদের অধিকার রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিশ্বব্যাপী মীনা দিবসে প্রাথমিক বিদ্যালয়, ব্র্যাকসহ সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, এনজিওগুলোর শিক্ষাপ্রকল্পে মীনা কমিক বইগুলো সহায়ক পাঠ উপকরণ হিসেবে ব্যবহƒত হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলো নানা কর্মসূচিও গ্রহণ করে থাকে।

সর্বোপরি, মেয়েশিশুরা শিক্ষায় আগের তুলনায় এগিয়ে থাকলেও নানা কর্মসূচি হাতে নেয়া সত্ত্বেও বাল্যবিবাহ, লিঙ্গবৈষম্য, যৌতুক না দেয়ার দায়ে মেয়েশিশুদের প্রতি সহিংসতা এখনও কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না, সেই ক্ষেত্রে মেয়েদের পূর্ণ স্বাধীনতা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। তবে মীনা কার্টুনের সচেতনতামূলক বার্তার মাধ্যমে আমরা আমাদের মেয়েশিশুদের অধিকার রক্ষায় আগের থেকে অনেকটা সচেতন হতে পেরেছি। আগে যেখানে মেয়েদের বাড়ির চৌকাঠ পেরোনোই দায় হয়ে গিয়েছিল, এখন মেয়েরা  শুধু ঘর নয়, যেন বাড়ির চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে বাইরের জগতেও পা বাড়াতে পারে সেদিকেও সমাজ ব্যবস্থা এগিয়ে গিয়েছে। আর এখন বিভিন্ন সমাজে নারী কল্যাণ সমিতিগুলো সমাজ ব্যবস্থার নারী অধিকার নিয়ে সচেতন হওয়ারই একটি উদাহরণ। এছাড়া শুধু নারী নয়, সমাজের সব মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতসহ যেকোনো সমস্যা মোকাবিলায় কীভাবে সমাধান করা যায়, সেগুলো ও মীনা কার্টুন অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় তুলে ধরায় প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষগুলো এখন বিষয়গুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে অনেকটা এগিয়ে  গেছে। সুতরাং বলাই যায়, মীনা কার্টুন আমাদের সমাজ পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে যদি প্রশ্ন করা হয় মীনা কার্টুন দেখে আমরা সমাজকে বদলাতে পেরেছি কি নাÑসেই প্রশ্নের উত্তরে আমরা সহজেই বলতে পারি, মীনা কার্টুন দেখে আমরা পুরোপুরি সমাজকে বদলাতে পারিনি। এখনও আমাদের সমাজে যৌতুক, বাল্যবিবাহ, মেয়েদের কোণঠাসা করে রাখা, উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা, চাকরির ক্ষেত্রে যৌন হয়রানি, বাসে যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, সমাজে কটূক্তি আরও অনেক বিষয় নিয়ে আমাদের সমাজে এখনও পরিবর্তন আসেনি। তবে আমাদের সমাজের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি মীনা কার্টুনে দেখানো হয়েছে। আর বর্তমান পরিপ্রক্ষিতে, আমাদের বর্তমান সমাজে মীনা কার্টুনকে নতুন সুরে চালু করা অতীব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মীনা কার্টুন নিয়ে একটা সময় আমরা দেখেছি, মীনা কার্টুনের প্রতি মানুষ আকৃষ্ট ছিল, মীনা কার্টুনকে ভালোবাসত, মীনা কার্টুনকে ভালো লাগত। কিন্তু কালের বিবর্তনে যে মীনা কার্টুনে সমাজের পরিবর্তনের দিকগুলো, সমাজের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরা হতো, সেই কার্টুন এখন প্রায় বিলুপ্ত। মীনা কার্টুনের ছবি অনেক বইতেই  থাকতে পারে, কিন্তু এই ছবি কিংবা এই মীনা কার্টুনের কার্যক্রম কী ছিল বর্তমান প্রজš§ বা বর্তমান সমাজ যার কথাই বলি না কেন কেউই তা সুস্পষ্টভাবে জানে না। আর তাই বর্তমান সমাজের সামনে মীনা কার্টুনের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরতে হবে। এমনকি সে সময়ে সমাজ গঠনে মীনা কার্টুন কী ভূমিকা পালন করেছে তা বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। নতুন প্রজন্ম কে নতুন করে সাজাতে, নতুন আঙ্গিকে সমাজকে গড়ে তুলতে, সমাজের সব কুসংস্কার ও বিদ্রƒপ মুছে দিতে আবারও মীনা কার্টুনের প্রয়োজন। সমাজ পরিবর্তনের নতুন আঙ্গিক নিয়ে আবারও

ফিরে আসুক মীনা কার্টুন। নারীর প্রতি সমাজের মানুষের ছেলে-মেয়ের বিভেদ, নারীর প্রতি প্রতিহিংসা, নারীকে কোণঠাসা করে রাখা, নারীর

প্রতি বৈষম্য এগুলো বন্ধ করতে হবে। সমাজ নির্মাণে মীনা কার্টুন বিভিন্ন আদর্শ, নীতি ও দিকসমূহ আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। সমাজের মানুষের কল্যাণের জন্য, সচেতনতার জন্য সেগুলো আমাদের মধ্যে ফিরে আসুক।

আর শিক্ষাকে যেখানে নারী মুক্তির হাতিয়ার বলা হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করলে, গত দুই বছরে মেয়েশিশুদের শিক্ষার হার কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে তা এই মরণব্যাধি কভিড পরিস্থিতি উতরাতে পারলেই স্পষ্ট হবে। তাই মেয়েশিশুদের এই সমাজের তৈরি বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে হলে সবার আগে মেয়েদের নিজেদের নিজ নিজ জায়গা থেকে সোচ্চার  হতে হবে। কেননা এই ছেলে-মেয়ে বৈষম্যের পেছনে প্রধান ভূমিকায় পরিবারের সদস্যরাই একধাপ এগিয়ে, তাই এই মানসিকতা পরিবর্তনের সূচনা হোক নিজ পরিবার থেকেই। তেমনিভাবে সরকারের পাশাপাশি সমাজের মানুষকেও নারী অধিকার রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।   

শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয় ➧

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০