দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণায় উঠে এসেছে, বাসের নিবন্ধনসহ নানা সেবা পেতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএকে বছরে ৯০০ কোটি টাকার বেশি ঘুষ দিতে হয়। এর বাইরে ঘুষ দিতে হয় দলীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী; ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ; মালিক-শ্রমিক সংগঠন এবং পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিদের। দেশের ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস-মিনিবাসের ৯২ শতাংশের মালিকানা ও পরিচালনায় রাজনীতিকেরা যুক্ত। এর মধ্যে অন্তত ৮০ শতাংশের মালিকানায় আছেন ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। মঙ্গলবার রাজধানীতে সংবাদ সম্মেলনে ‘ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহন ব্যবসায় শুদ্ধাচার’ শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে টিআইবি। এর আগেও টিআইবি নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছে এবং সরকার ও সরকারি সংস্থা বরাবরই তা অস্বীকার করেছে। এবারও অস্বীকার করবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমাদের গণপরিবহন খাত সত্যি আগাগোড়া দুর্নীতিতে জর্জরিত।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিআরটিএকে অবশ্যই চাঁদা বা অনিয়ম বন্ধে দায়িত্ব নিতে হবে। অথচ সংগৃহীত চাঁদার বড় অংশই তারা পায়। বাসের নিবন্ধন, সনদ গ্রহণ এবং কাগজপত্র হালনাগাদ করতে ঘুষ দিতে হয়। এটি দেশীয় প্রবচন ‘বেড়ায় ক্ষেত খাওয়ার’ বড় উপমা। তাহলে কী করে বন্ধ হবে অনিয়ম ও যাত্রী সাধারণের ভোগান্তি!
প্রশ্ন হচ্ছে, পরিবহনগুলোর কাছ থেকে মালিক-শ্রমিকদের সংগঠন কেন চাঁদা নেয়। চাঁদাবাজির কারণে ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে নেয়া হবে? গণপরিবহনের সেবাগ্রহীতা তথা যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হবে অতিরিক্ত অর্থ। এছাড়া প্রতি বছর গণপরিবহন রক্ষণাবেক্ষণ খাতের খরচ ধরেই নির্ধারিত হয় বাসভাড়া। বিআরটিএকে হাতে রাখলে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার না করলেও চলে। এভাবে সড়কে দাবড়ে বেড়ায় ফিটনেসবিহীন ও রুট পারমিটবিহীন লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি। এসব গাড়ির মালিক-চালকরা নিয়মিত চাঁদা দিয়ে গাড়ি চালায়। ফলে তাদের আইন-কানুন পরিপালনের বাধ্যবাধকতা নেই। আবার সরকারও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে গাড়ি ও পরিবহণ শ্রমিকদের ব্যবহার করে। তাই তাদের ‘ছাড়’ তো দিতেই হয়!
চাঁদাবাজির দুষ্টচক্রের দৌরাত্ম্যের খেসারত শেষ পর্যন্ত দিতে হয় যাত্রীসাধারণকে। সাধারণ মানুষকেই চাঁদার বাড়তি বোঝা বইতে হয়। তাদের যাতায়াত ভাড়া যায় বেড়ে। আবার পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির প্রভাবে নিত্যপণ্যের দামও বেড়ে যায়।
সাধারণ মানুষ কতভাবে ভোগান্তির শিকার হবে! সরকার গণপরিবহনে নির্ধারিত ভাড়া আদায় নিশ্চিত করে না। আবার সংঘবদ্ধ পরিবহন শ্রমিকরা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করবে, এক জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে জনসাধারণ। সড়কে নানা অনিয়মের কারণে মামলা ও জরিমানার নজির আছে। কিন্তু অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কারণে দোষী গণপরিবহন মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা ও জরিমানা হয় খুবই কম। দুর্ভাগ্য হলেও পরিবহন সংগঠন সড়কে বাস চলাচলই বন্ধ করে দেয়। গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি বন্ধ হলে সড়ক দুর্ঘটনাও কমবে। তখন ফিটনেস সনদ ছাড়া রাস্তায় গাড়ি চলবে না। লাইসেন্সবিহীন চালক দিয়ে বাস চালানো যাবে না। অথচ চাঁদার ভাগ পায় বলে কঠোর হতো পারে না বিআরটিএ! জনগণ নানামুখী চাপে এক সীমাহীন দুর্ভোগে রয়েছে। সরকারের উচিত হবে অন্তত সরকারি নির্দেশনা মেনে যাতে গণপরিবহন ভাড়া আদায় করাসহ সড়কে নিয়মনীতির যথাযথ পরিপালন নিশ্চিত করা।