পরিবার থেকেই শুরু হোক শিশুর নৈতিকতার শিক্ষা

লায়লা আরজুমান্দ বানু: একটি সুন্দর সমাজ ও আর্দশ রাষ্ট্র গঠনের জন্য সুনাগরিকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সুনাগরিক হওয়ার পেছনে পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যে সমাজের নাগরিকবৃন্দ নৈতিকতার মানে যতটুকু উত্তীর্ণ, সে সমাজে ন্যায়নীতির বাস্তবায়ন ততটা সুন্দর হয়। অনৈতিক চর্চা সমাজের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন ও শান্তিপূর্ণ বসবাসের পরিবেশ সৃষ্টিতে অন্তরায় সৃষ্টি করে।

ইংরেজি গড়ৎধষরঃু, যার অর্থ হলো ভদ্রতা, ন্যায়পরায়ণতা ও উত্তম আচরণ। এটি মূলত উদ্দেশ্য, সিদ্ধান্ত এবং কর্মের মধ্যকার ভালো-খারাপ, উচিত-অনুচিতের মধ্যে পার্থক্যকারী। নৈতিকতা হলো কোনো মানদণ্ড বা নীতিমালা, যা নির্দিষ্ট কোনো আদর্শ, ধর্ম বা সংস্কৃতি থেকে আসতে পারে। আবার এটি এমন এক বিষয়, যা সমগ্র মানুষের জন্য কল্যাণকর, তা থেকেও আসতে পারে। নৈতিকতাকে সঠিকতা বা ন্যায্যতাও বলা যায়। নৈতিকতার একটি আদর্শ উদাহরণ হলোÑ‘আমাদের উচিত অন্যের সঙ্গে সেভাবেই আচরণ করা, যেমনটা আমরা নিজেরা অন্যের থেকে আশা করব।’ অপরদিকে, অনৈতিকতা হলো নৈতিকতারই সম্পূর্ণ বিপরীত, যা অসচেতনতা, অবিশ্বাস ও উদাসীনতারই বহিঃপ্রকাশ।

শিশুকাল থেকে প্রতিটি পরিবারেই শিশুদের জন্য নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। নৈতিক শিক্ষা হলো সে শিক্ষা, যা মানুষকে ভালো ও মন্দ, ন্যায় ও অন্যায় এবং শুভ ও অশুভের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে তার জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। যেসব পরিবারে বাবা-মা নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত, তাদের সন্তান স্বাভাবিকভাবেই শিশুকাল থেকেই সেই শিক্ষা তাদের মানসপটে গ্রহণ করে। সুকুমার মানবিক গুণাবলি শিশুকাল থেকেই পারিবারিক শিক্ষার মাধ্যমে প্রস্ফুটিত হয়। এ বয়সে শিশু যে শিক্ষাটি পেয়ে থাকে, সেটি তার সারাজীবনের পথ চলায় পাথেয় হয় এবং জীবনকে সহজ করে দেয়। আমাদের দেশের আদর্শলিপিতে বহুল প্রচলিত একটি ছড়া‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি। আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে, আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে।’ শিশুর নৈতিকতা শিক্ষার ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এছাড়া পারিবারিকভাবে শৈশবকাল থেকেই শিশুরা ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমেও নৈতিক শিক্ষা লাভ করে থাকে। শিশুদের যে কোনো অন্যায় আচরণ, মিথ্যা কথা বলা এবং ভুল করলে শিশুকে তা যথাযথভাবে সংশোধনপূর্বক সঠিক দিকনির্দেশনা বাবা-মা ও গুরুজনদের দেয়া অভিভাবকদের নৈতিক দায়িত্ব। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় দায়িত্বরত শিক্ষকদের উচিত শিশুদের কাছে জীবনের চলার পথে সঠিক দিকনির্দেশনা তুলে ধরা। ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, সহপাঠীদের প্রতি আন্তরিকতা ও সহযোগিতাসুলভ মনোভাব গড়ে তুলতে শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

শিশুদের নৈতিক শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার একক বা যৌথ যে কোনো ধরনের হতে পারে। একক পরিবার শুধু মা-বাবা, ভাই-বোন এবং যৌথ পরিবার বাবা-মা, দাদা-দাদি, চাচা-চাচি ও ফুপু নিয়ে হয়ে থাকে। পরিবার থেকেই শিশু তার নৈতিক শিক্ষা পেয়ে থাকে। যেমন, শিশু যখন তার বাবা-মাকে অন্যদের সঙ্গে ভালো আচরণ বা দুস্থদের সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করতে দেখে, তখন তা থেকে সে শেখে এবং অনুশীলন করে। শিশুর মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটে মূলত পরিবারের সদস্যদের সংস্পর্শে থেকে। পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই শিশুদের সৎভাবে জীবনযাপনের শিক্ষা ও সততার শিক্ষা দেয়া উচিত। তারা যেকোনো ধরনের ভুল করুক না কেন, সত্য বলায় উৎসাহিত করতে হবে। এজন্য বাড়ির বড়দেরও শিশুর সামনে মিথ্যা বলা বা চর্চা করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

পরিবারের গুরুজনসহ সবাইকে সম্মান করা শেখাতে হবে ছোটবেলা থেকেই। পরিবারে যে গৃহকর্মী, তাকেও সম্মান করতে শেখানো বাবা-মায়ের অন্যতম দায়িত্ব। শিশুর সামনে অন্যদের হেয় করা বা কটাক্ষ করা থেকে বড়দের নিবৃত্ত থাকতে হবে। এতে শিশুরা তাদের শৈশবকাল থেকেই বড়দের কাছ থেকে নৈতিক আচরণের শিক্ষা পাবে। প্রতিবেশীর সঙ্গে ভালো আচরণ করা, তাদের সমস্যায় এগিয়ে যাওয়া এবং তাদের সুখে-দুঃখে পাশে থাকার বিষয়ে শিশুকে মানসিকভাবে তৈরি করতে হবে। শিশুরা যেহেতু অনুকরণপ্রিয়, তাই বড়রা যা করে, তারা তা শেখে। এজন্য অভিভাবকদের আচরণ হতে হবে মার্জিত, সুন্দর ও শিক্ষণীয়।

জীবনে সাফল্য লাভ করতে হলে ধৈর্যশীল হওয়ার বিকল্প নেই। শিশুর মধ্যে ধৈর্যধারণ করার প্রবণতা তৈরি করতে হবে। কোনো কাজে বিফল হলে হতাশ না হয়ে তাকে ধৈর্যশীল হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে। পরিবারে শুধু বাবা-মা বা পরিবারের সদস্যদের জন্য ভালোবাসা নয়, ছোট-বড়, ধনী-গরিব ও পশুপাখির প্রতিও ভালোবাসা শেখাতে হবে। অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সহযোগিতামূলক মনোভাব শৈশবেই গড়ে তুলতে হবে।

ছোটবেলা থেকেই শিশুকে ধর্মীয় চর্চার শিক্ষা দিতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যেই নৈতিকতার বীজ প্রোথিত থাকে। শুধু তার নিজের ধর্ম নয়, অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া শেখাতে হবে। ধর্ম যার যার, কিন্তু ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠানে সবার অংশগ্রহণে সমান অধিকার এ শিক্ষা ছোটবেলা থেকেই তার মননে স্থাপন করতে হবে।

নম্র বা বিনয়ী হওয়া নৈতিকতা শিক্ষার মধ্যে অন্যতম। ছোটবেলা থেকেই শিশুকে নম্র বা বিনয়ী হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে, যেন তার মধ্যে অহংকার বোধের জš§ না নেয়। শিশুকে বুঝিয়ে দিতে হবে, নম্র ও বিনয়ী আচরণের মধ্য দিয়ে সে সবার কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। কোনো সাফল্যে যেন সে অহংকারী হয়ে না ওঠে। এছাড়া শিশুদের মনে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করতে হবে। নিজের দেশের সঠিক ইতিহাস শিশুদের মধ্যে তুলে ধরতে হবে। নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকলে কেউ কখনও খারাপ বা অনৈতিক কাজে জড়াতে পারবে না।

বাবা-মায়ের উচিত আর্থিক সামর্থ্যরে বাইরে গিয়ে শিশুর কোনো চাহিদা পূরণ না করা। শিশু যেন বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে না পড়ে, সেদিকে যেমন খেয়াল রাখতে হবে, তেমনি বাবা-মায়ের প্রকৃত আর্থিক সামর্থ্য কতটুকু, তা শিশুকে বুঝিয়ে দিতে হবে। এছাড়া টিভি, মোবাইল ও ভিডিও গেমসে শিশু যেন আসক্ত না হয়ে পড়ে, সেদিকে বাবা-মায়ের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। এসব ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রিত আচরণও বাঞ্ছনীয়।

সন্তানের পাশে থেকে তাদের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অভিভাবকদের তুলে ধরতে হবে। অভিভাবকদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, শৈশবকাল খুব স্বল্প সময়। তাই শৈশবে শিশুর নরম মনে সব সদ্গুণাবলির সন্নিবেশিত করতে সর্বাত্মকভাবে প্রচেষ্টা নিতে হবে। এ বিষয়গুলো পরিবারের প্রতিটি সদস্য মেনে চললে পরিবারে একটি সুষ্ঠু পরিবেশ বিরাজ করবে। এতে শিশুরা নৈতিক শিক্ষা লাভের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে মানবিক গুণাবলিও সুন্দরভাবে প্রস্ফুটিত হবে। শিশুরা এ দেশ ও সমাজের জন্য সুনাগরিক রূপে নিজেদের গড়ে তুলতে পারবে। সুষ্ঠু সমাজ বিনির্মাণে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতীয় শুদ্ধাচার নীতিমালার মাধ্যমে সবাইকে নৈতিকতার শিক্ষা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এ শুদ্ধাচার কর্মসূচি তখনই সফল হবে যখন শিশুরা পরিবার থেকে নৈতিকতার শিক্ষায় আলোকিত হয়ে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমাদের শিশুরা শুদ্ধাচারী হয়ে বেড়ে উঠলে তবেই সফল হবে আমাদের সব শুদ্ধাচার চর্চা।

পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০