নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্যাংকের আমানতের চেয়ে বেশি লাভ পাওয়ায় সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকেছেন বিনিয়োগকারীরা। চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) প্রথম সাত মাসে ৬৫ হাজার ৬২১ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মোট বিনিয়োগের বেশিরভাগই পারিবারিক ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে। কারণ আলোচ্য সময়ে পারিবারিক সঞ্চয়পত্রে মোট ২৪ হাজার ৩১০ কোটি টাকা এবং তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ১৮ হাজার ৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন গ্রাহক।
সম্প্রতি সঞ্চয়পত্র কিনতে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার। কারণ ব্যাংকে আমানত রাখলে যে পরিমাণ সুদ পাওয়া যায়, সঞ্চয়পত্রে তার চেয়ে বেশি লাভ পাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা এদিকে ঝুঁকছিলেন। সঞ্চয়পত্রে এত বিনিয়োগ আসছিল যে তা বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সঞ্চয়পত্র কিনতে বেশ কিছু কড়াকড়ি আরোপ করে সরকার। কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) বাধ্যতামূলক করা এবং ডিজিটাল নিবন্ধন ও একক নামে সঞ্চয়পত্র কেনার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ ছিল অন্যতম। ফলে গত বছরের শুরু থেকে বিক্রি কমতে থাকে সঞ্চয়পত্র। প্রথমে কয়েক মাস সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমলেও বর্তমানে এর ঊর্ধ্বগতি লক্ষণীয়।
সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ৬৫ হাজার ৬২১ কোটি ১৭ লাখ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। সুদ-আসল বাবদ গ্রাহকদের শোধ করা হয়েছে ৩৯ হাজার ৯১৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এ হিসাবে নিট বিক্রির পরিমাণ হচ্ছে ২৫ হাজার ৭০২ কোটি ১৭ লাখ টাকা। একক মাস হিসেবে জানুয়ারিতে মোট ১০ হাজার ৬৪৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর বিপরীতে মূল অর্থ পরিশোধ হয়েছে পাঁচ হাজার ৪২৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সেই হিসাবে জানুয়ারিতে নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ২১৫ কোটি ছয় লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা ও ব্যাংকে আমানতের সুদহার কম হওয়ায় সাধারণ মানুষ এখন সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ মনে করছেন। তাই বিভিন্ন শর্ত পরিপালন করেও সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকছেন বিনিয়োগকারীরা।
চলতি (২০২০-২১) অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। বিশাল ঘাটতি মেটাতে এবার সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার, সমাপ্ত অর্থবছরে বাজেটে যার লক্ষ্য ছিল ২৭ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬৭ হাজার ১২৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। এর মধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ ৫২ হাজার ৬৯৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা শোধ করা হয়। এ হিসাবে নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের মোট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৯০ হাজার ৩৪২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, যা ছিল এ যাবৎকালে এক অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি বিক্রি। ওই বছরে সুদ-আসল বাবদ বিনিয়োগকারীদের শোধ করা হয় ৪০ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মূল কারণ হচ্ছে এর সুদটা ভালো। এছাড়া এখন সুদের টাকা পেতে গেলে আগের মতো সই-স্বাক্ষরের ঝামেলা করতে হয় না। সবকিছু অনলাইনের মাধ্যমেই হয়ে যায়। প্রক্রিয়াটা সহজ হয়েছে। এখানে মূলত স্বল্প আয়ের মানুষ টাকা রাখে। এতে তারা একটা ভালো টাকা পায়। তাই অনেক শর্ত পুরণ করতে হলেও এখানেই বিনিয়োগ করছেন গ্রাহক।
তিনি আরও বলেন, এখন আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয়। তারা আমানত ফেরত দিতে পারছে না। তাই বেশি সুদের অফার করলেও সেখানে টাকা রাখছে না জনগণ। কিছু কিছু ব্যাংকেও এই সমস্যা রয়েছে। তবে বেশিরভাগ ব্যাংক এখনও ভালো। যাদের অনেক টাকা আছে তারা জায়গা-জমি ও ফ্ল্যাট কিনছে। অত্যাবশকীয় জিনিসপত্র ছাড়া কোনো খরচ করছে না কেউই। তবে ব্যাংকের সুদহার (নয়-ছয়) নির্ধারণ করে দেয়ার সিদ্ধান্তটা মোটেও সঠিক ছিল না বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।