পরিবেশকে গুরুত্ব না দিলে ধ্বংসযজ্ঞে নিমজ্জিত রোল মডেল হবে দেশ

মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: দাবদাহ একটি দুর্যোগ। বাংলাদেশ এই দুর্যোগের মুখোমুখি। এই দুর্যোগের কারণ বনভূমি ও গাছপালা কেটে উজাড় এবং জলাধার ভরাট করে সাবাড়ের পাশাপাশি অতিমাত্রায় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি। ফলে দেখা দিয়েছে জলবায়ু বিপর্যয়, যা কথিত উন্নয়নের কফিনে শেষ পেরেক ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাই প্রতিদিন-ই আমরা ক্রিকেট বোর্ডের স্কোরের মতো নিরপরাধ মানুষের অপমৃত্যুর স্কোর বোর্ডে দেখছি। দাবদাহে প্রাণ-প্রকৃতি ও মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। এটি একটি নীরব ঘাতকও বটে।

দেশের সর্বত্র তাপপ্রবাহ ও লু হাওয়া জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রতিফলিত রূপ। এপ্রিল মাসজুড়ে দেশের ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটারেই মরুর উষ্ণতা ছিল। একেক শহরের মানুষের কাছে তাপপ্রবাহের অনুভূতি একেক রকম। কোনো শহরে বছরে কমপক্ষে যদি ১০ দিন তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নাগরিকের শরীরের গড় তাপমাত্রার চেয়ে বেশি হয়, এমন পরিস্থিতি বিপজ্জনক ধরা হয়। আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৮১ শতাংশ বৃষ্টি কম হয়েছে। তাই রাজধানীসহ সারাদেশে অসহনীয় গরম ও তীব্র তাপদাহে জীবন বিপর্যস্ত। যদিও ‘মানুষ জাতি’ কবিতায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, ‘এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত একই রবি শশী মোদের সাথী, শীতাতপ ক্ষুধা তৃষ্ণার জ্বালা সবাই আমরা সমান বুঝি।’

তাপদাহে কিছু পেশার মানুষ উচ্চ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে, যেমনÑট্রাফিক পুলিশ, শ্রমিক, রিকশাচালক, কৃষক, মার্কেটিং-সংশ্লিষ্টরা। সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকেন অন্তঃসত্ত্বা, শিশু, প্রবীণ ও অসুস্থ ব্যক্তি। তাপপ্রবাহ মানুষ ও প্রাণীর শরীরে পানিশূন্যতা ও ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। আবহাওয়া অধিদপ্তর তীব্র তাপপ্রবাহ থেকে জনগণকে সুরক্ষিত থাকার জন্য ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি করছে। খরতাপ একে একে ভেঙেছে গত ৭৬ বছরের সব রেকর্ড। টানা এক মাস তাপপ্রবাহ একটি বিপজ্জনক রেকর্ড! তাপপ্রবাহজনিত মৃত্যুর রেকর্ডও ছাড়ছে! গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিলে হিট স্ট্রোক ও গরমজনিত রোগে মারা গেছেন ৯৫ জন। পরিবেশগত ও জলবায়ু বিপর্যয় কারণে এই দুরবস্থা। যদিও ২০৩০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্ধ বনের গাছ কাটা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবু বন উজাড় থামছে না। ফলে প্রতি বছরই তাপদাহের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। 

২০২৩ সালেও প্রচণ্ড তাপদাহে বসন্তকালে (এপ্রিল মাসে) দেশের অনেক স্থানে রেললাইন বেঁকে গিয়েছিল, এতে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছিল কি? ২০২৪ সালে যশোর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গাসহ দেশের অনেক সড়ক-মহাসড়ক এর পিচ গলে গিয়েছে, এতেও যথাযথ কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ নেবে কি? তাপপ্রবাহের কারণে শুধু ঢাকা শহরের জিডিপির ৮ শতাংশ ক্ষতি হয়, প্রতি বছর প্রায় ৬০০ কোটি ডলার। বর্তমান বাজার দরে (প্রতি ডলারের দাম ১১০ টাকা ধরে) এর পরিমাণ ৬৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ তাপদাহের কারণে বাংলাদেশ বেশ বিপজ্জনক অবস্থায় আছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, প্রতি হেক্টর জমিতে কমপক্ষে শূন্য দশমিক শূন্য ৫ হেক্টরে বিভিন্ন ধরনের গাছপালার সমাবেশকে বনভূমি বলে। যেকোনো দেশের আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে বন বিভাগ নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ প্রায় ২৩ লাখ হেক্টর; যা দেশের আয়তনের শতকরা ১৫ দশমিক ৫৮ ভাগ। আর বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ দেশের আয়তনের শতকরা ২২ দশমিক ৩৭ ভাগ।

বাংলাদেশ পৃথিবীতে বনভূমি দখলের শীর্ষে আছে। সারাদেশে দখল করা বনভূমি ২ লাখ ৫৭ হাজার একর। দখল হওয়া জমির ৫৯ হাজার ৪৭১ একর কক্সবাজারে। চট্টগ্রাম ও সিলেটেও ঠিক একই পরিস্থিতি। বনের জমি দখলের তালিকায় আছে ৮৮ হাজার ২২৫ ব্যক্তি ও সংস্থার নাম। বন দখল করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা নির্মাণ করেছে। সম্মিলিতভাবে ১ লাখ ৩৮ হাজার একর সংরক্ষিত বন দখল করেছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ক্ষমতার বলয়ের কাছের মানুষজন হওয়ায় তাদের কিছুই হচ্ছে না। ২০২১ সালে সরকারের পক্ষ থেকে তথ্য-উপাত্ত হাতে নিয়ে বেশ আলোচনা ও হুমকি দেয়া হলেও আজ পর্যন্ত বন্ধ হয়নি নির্বিচারে বন উজাড়, জমি দখল।

এছাড়া দেশের অনেক জায়গায় দুই লেনের রাস্তা চার লেন করা হচ্ছে। আর রাস্তার পাশে যে বিশাল বিশাল গাছ ছিল, তা কেটে ফেলা হয়েছে। ফলে রাস্তার দুই পাশে গাছের সারি এখন দেখা যায় না। এজন্য-ই সড়কের ধারে বাসের জন্য যে অপেক্ষা করবÑকোনো ছায়া নেই। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় তথাকথিত উন্নয়নের নামে নির্বিচারে গাছ কাটা ও জলাধার (নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, ডোবা, লেক ইত্যাদি) ভরাটের মধ্য দিয়ে কয়েক দশকে দেশজুড়ে পরিবেশ-বিনাশী তাণ্ডব চালানো হয়েছে। কোনো এক সময় দেশে ১৩শ নদী ছিল। নদীর ধারের পথ, সবুজ বনও যেন উধাও হয়ে গেছে। সবুজ মাঠ গিলছে কংক্রিটের ভবন; দখল হয়ে যাচ্ছে নদী, নদীর ধারের পথটুকুও। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ল্যান্ডসেট স্যাটেলাইট গবেষণা অনুযায়ী, গত ২৮ বছরে শুধু ঢাকা থেকেই প্রায় ৮৫ শতাংশ জলাভূমি হারিয়ে গেছে। অন্য আরেক গবেষণা তথ্য মতে, সাড়ে তিন দশকে ঢাকা ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জলাভূমি হারিয়ে গেছে। ঢাকাসহ সারাদেশে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। ঢাকায় যেখানে ১৯৯৬ সালে ২৫ মিটার নিচে পানি ছিল, তা এখন চলে আসছে ৭৫ মিটারে। পাশাপাশি এই সময়ে ৭৫ শতাংশ নির্মাণ এলাকা বা স্থাপনা বাড়ছে। অর্থাৎ সবুজ গাছপালা এবং জলাধার ধ্বংস করে কংক্রিটের স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। 

দেড়শ বছর আগে ঢাকা চারপাশে শালবন ছিল। বর্তমানে ঢাকাতে শালবন তো দূরের কথা কোনো ফলের গাছ খুঁজে পাওয়া যাবে না। কোনো এক সময় ঢাকাতে বাঘ ছিল। ছিল প্রবহমান খাল যার সংখ্যা অগণিত। কমপক্ষে দশটি নদী ছিল যার মধ্যে পাঁচটি বেশ বড় নদী। এখন শুধুই বুড়িগঙ্গা আর তুরাগের শীর্ণ স্রোতধারা বহমান। পৃথিবীর মধ্যে ঢাকা একমাত্র শহর যার নিজস্ব গাছ নিজস্ব নদী সবকিছুই বিলীন হয়ে গেছে। ঢাকার সৌন্দর্য শুধু কংক্রিটে চাপা পড়ে গেছে। ভৌগোলিকভাবে ঢাকার অবস্থান কলকাতা কিংবা চেন্নাইয়ের মতো হতো, তাহলে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হলেও হতে পারত। শুধু ভৌগোলিক কারণে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমাবদ্ধ রয়েছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় তা উঠে এসেছেÑঢাকার বাতাসে ক্যানসার সৃষ্টিকারী আর্সেনিক, সিসা ও ক্যাডমিয়ামের পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রার প্রায় দ্বিগুণ। লেড-অ্যাসিড ব্যাটারি এবং ই-বর্জ্য পুনর্ব্যবহারকারী শিল্প, কয়লা, ইটভাটা এবং যানবাহন এসব রাসায়নিক উপাদানের উচ্চ ঘনত্বের জন্য দায়ী। এছাড়া গবেষণায় শহরের বাতাসে ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে এমন আরেকটি উপাদান কোবাল্টের উচ্চমাত্রায় উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। তাপদাহের সঙ্গে বিষাক্ত বাতাস জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে দিচ্ছে। পৃথিবীর বড় বড় শহরে তাদের নিজস্ব গাছপালা বিদ্যমান রয়েছে কিন্তু ঢাকার কোথাও মানুষের ঘনত্বানুসারে গাছের অস্তিত্ব নেই।

সড়ক চওড়া করার জন্য রাস্তার ধারের ও ফুটপাতের বহু গাছ কাঁটা হয়েছে। এখানে শেষ নয়, সড়কের মধ্যে দ্বীপ (আয়ল্যান্ড) ও ফুটপাতের মধ্যেও গাছগুলো কেঁটেও সাবাড় করা হচ্ছে। মানুষকে ছায়া দেয়ার গাছটি কেঁটে গ্লাসে মোড়ানো অট্রালিকা তৈরি করে এবং জলাধার (পুকুর, খাল, লেক, নদী) ভরাট করে রাষ্ট্র উন্নয়নের সূত্র আবিষ্কার করছে। এই কথিত উন্নয়নের ধারাই দম বন্ধের কারণ। নগরের দাবদাহ অনুভবের বিষয়। বিশেষভাবে তাপমাত্রা অনুভবের যে তীব্রতা তা আগের চেয়ে অনেক বাড়ছে। অর্থাৎ তাপমাত্রা বৃদ্ধির চেয়ে অনুভবের মাত্রা বাড়ছে। অনুভবটা সরাসরি তাপমাত্রার সঙ্গেই শুধু জড়িত নয়, বরং পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গেও জড়িত। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় আমরা সেই পারিপার্শ্বিকতাকে কয়েক দশক ধরে ধ্বংস করা হচ্ছে। একটি সড়কও রাখা হয়নি, যেখানে গাছের ছায়া পাওয়া যায়। জলাধারগুলো ভরাট করা হয়েছে, বিশেষ করে পুকুর, খাল ও নদীগুলো ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।

গ্লাসে মোড়ানো ভবন, পাথরের দেওয়াল বা ছাদ অথবা পিচঢালা রাস্তাকে সূর্যের আলো রিফ্লেকশন তৈরি করে বায়ু তাপমাত্রার প্রচুর তীব্রতা তৈরি করছে। গ্লাস মোড়ানো ভবন ও কংক্রিটের ছায়া থেকে ঠিক তীব্র তাপমাত্রাই অনুভব হবে। অনুভবের এই তীব্রতাই আমাদের জন্য কাল হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের যথেচ্ছা ব্যবহার। এই যন্ত্র দিয়ে আমার ঘরের তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমিয়ে ফেলছি। এতে প্রতিবেশগত বিরাট অবক্ষয় তৈরি করছি। মানে ২ বা ৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা অবশ্যই গায়েব হয়ে যাচ্ছে না। প্রতিবেশীর গায়ের ওপর ঢেলে দিচ্ছি। যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহার করতে পারছে না, সে আমার ব্যবহারের কারণে ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা অনুভব করছে। 

ঢাকার ২০ শতাংশ স্থানে গাছপালা থাকা উচিত হলেও আছে মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশ। ঢাকার অদূরে সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ শতাংশ এলাকায় গাছপালা ও ২২ শতাংশে জলাভূমি। এ কারণে একই সময় ঢাকার চেয়ে সেখানকার তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম থাকে। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রমনা পার্ক এলাকার তুলনায় ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকায় তাপমাত্রার থাকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। ১৯৫২ সালে তৈরি করা বিল্ডিং কোড বদলে গিলেও ২০০৯ সালে আরও যুগোপযোগী করা হলেও তার কার্যক্রম দৃশমান হয়নি। 

বনভূমি সাবাড় করে ও ফার্নিচার তৈরির জন্য গাছ কাঁটা হয়েছে। জলাধার ভরাট করে বহু বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। বাড়ি ভাড়া দিয়ে টাকা পাচ্ছি, আর এখন শুয়ে-বসে খাচ্ছি। ভালোই ছিলাম কিন্তু ইদানীং ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে চলছে। অবশ্য এসি লাগাইয়া তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব কিন্তু আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা বলছে এদেশের তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে যাবে। আমরা হয়তো সেন্টু গেঞ্জি পরে, লুঙ্গি পরে দিন পার করতে পারব কিন্তু আমাদের পরবর্তী প্রজš§ কী করবে? ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা তো এসিতে কমাইতে পারবে না। তাছাড়া এসি ক্রয় করতে গিয়ে তো তারা চাল-ডাল ক্রয় করতে পারবে না। কারণ ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ধান, গম ইত্যাদি চাষ করবে কীভাবে? তাছাড়া ধান, গম গাছ তো পুড়ে যাবে!

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার তথ্য বলছে, বন উজাড়ের সঙ্গে বৈশ্বিক তাপমাত্রাও ক্রমাগত বাড়ছে। গাছ বেড়ে ওঠার সঙ্গে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। কিন্তু যখন কোনো বন কেটে ফেলা হয় বা পুড়িয়ে ফেলা হয় তখন আর্দ্রতা কমে যায়; ফলে অন্য সব গাছপালা শুকিয়ে যায় এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে। 

কী কী কাজ করলে দাপদাহের মতো এই দুর্যোগ থেকে আমাদের জীবন, প্রাণ-প্রকৃতি বাঁচাতে পারব; তা নিয়ে কাজ করার এখনই সময়। কারণ আমরা জানি ‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়’। আইপিসিসির পঞ্চম প্রতিবেদন বলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের প্রায় ২ কোটি ৭০ লাখ মানুষ ঝুঁকিতে পড়বে। ২০১২ সালে প্রকাশিত ক্লাইমেট ভালনারেবিলিটি মনিটরের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতি বছর অতিরিক্ত ছয় লাখ মানুষ জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকিতে পড়বে।

এই অস্বাভাকিক তাপমাত্রায় হিট স্ট্রোকে পুলিশ, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী মানুষের মৃত্যু হয়েছে। চলমান তাপপ্রবাহের কারণে ভূ-পৃষ্ঠ চরম উত্তপ্ত যা শীতল করতে বা তাপমাত্রা কমাতে টানা বৃষ্টির প্রয়োজন। এই তীব্র গরমে ঢাকায় সাধারণ পথচারীদের স্বস্তি দিতে সুপেয় পানি, ওরস্যালাইন, সরবত ও ছাতার ব্যবস্থা করছে বাংলাদেশ পুলিশ, ঢাকা উত্তর সিটিকপোরেশন ও অনেক সামাজিক সংগঠন। এছাড়া সরকার কর্তৃক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে, এটি একটি স্বল্পকালীন সমস্যা লাগবের উদ্যোগ মাত্র। দীর্ঘমেয়াদে সমস্যার সমাধান করতে হলে সব গণস্থাপনায় (রাস্তার পাশে, উদ্যান ও বাস ও ট্রেন স্টেশনে) সুপেয় পানির ব্যবস্থার জন্য ওয়াটার ফাউন্টেন স্থাপন করতে হবে। শহরের তাপমাত্রা সহনীয় করতে হলে নগরে সবুজ উদ্যান তৈরি এবং রাস্তার পাশে ও ফুটপাতে প্রচুর গাছ লাগাতে হবে। শহরের মানুষের ঘনত্ব, যান্ত্রিক যানবাহন ও কলকারখানা বিবেচনায় জনজীবনের জন্য ৪০ শতাংশ সবুজায়ন জরুরি। সূর্যের আলো যেন মাটিতে পৌঁছাতে না পারে এবং গাছের তলদেশ দিয়ে যে বায়ু প্রবাহিত হয় তার মধ্য দিয়ে যেন হেঁটে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। কারণ হচ্ছে উন্নয়ন বা অর্জনের মূল উপজীব্য হচ্ছে মানুষ। সহনীয় তাপমাত্রা অনুভব করতে হলে গাছের ছায়ায় কাছে যেতে হবে। এছাড়া রাজধানী ঢাকায় প্রায় ২২ লাখের মতো ভবন রয়েছে। এই ভবনগুলোর ওপর ছাদবাগান করা হলে শহরের তাপমাত্রা অনেকাংশে কমে আসবে। তীব্র দাবদাহের মধ্যেও দেশে গাছ কাটা অব্যাহত থাকায় প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছে একটি পরিবেশবাদী সংগঠন। কিন্তু এর পাশাপাশি দরকার ছিল এয়ার কন্ডিশন (এসি) ও ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার ও ইটভাটা বন্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা।

পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অতিনিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য। মানুষের কল্যাণ অনেকাংশে নির্ভর করে প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর। বিশেষ করে, প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে মানুষ বেঁচে থাকে, জীবনীশক্তি পায়। মানুষের অতিমাত্রায় ভোগ-বিলাসের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সভ্যতা হুমকির সম্মুখীন। তাপদাহ নির্মূল করার জন্য প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগানো অতীব প্রয়োজন। গাছ প্রকৃতির অপূর্ব শোভা। গাছহীন পৃথিবী মলিন। গাছের অস্তিত্ব মানে প্রাণের অস্তিত্ব, প্রাণীর অস্তিত্ব। যে অঞ্চলে যত গাছপালা, সেই অঞ্চল তত বেশি প্রাণবন্ত। গাছ ছাড়া বেঁচে থাকার উপায় নেই। গাছ থেকে পাওয়া অক্সিজেন আমাদের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য। ঝুঁকিহীন এক সুন্দরতম নিরাপদ বিনিয়োগ গাছ। সবুজ শ্যামল নিসর্গ মূলত গাছকে ঘিরেই। প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে গাছ অবিকল্প ভূমিকা পালন করছে। 

আইনজীবী

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০