জুবায়ের আহমেদ: বাংলাদেশে যখন বিদ্যুৎ সহজলভ্য ছিল না, তখন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সৌরবিদ্যুতেই ভরসা ছিল মানুষের। সাদা-কালো টিভি, একাধিক লাইট, মোবাইল চার্জ দেয়া, টেপরেকর্ডার চালানো ও সৌরবিদ্যুৎ-উপযোগী ছোট ফ্যান ব্যবহার করা যেত তখন। মোমবাতি, হারিকেন ও কুপির সেই জমানায় কোনো ঘরে সৌরবিদ্যুৎ থাকা মানে সেই পরিবার পার্শ্ববর্তী বাসিন্দাদের মাঝে মধ্যমণি। কেননা সৌরবিদ্যুৎ থাকায় দূরদূরান্ত থেকে ব্যাটারি চার্জ করে এনে টিভি দেখা কিংবা টেপ রেকর্ডার চালানোর বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না। ফলে পাড়া-প্রতিবেশী টিভি দেখার জন্য সৌরবিদ্যুৎ থাকা ঘরকেই বেছে নিত। তখনকার সময়ে বেশ ব্যয়বহুল সৌরবিদ্যুৎ মোটামুটি স্বাবলম্বী পরিবারই নিতে পারত। ধীরে ধীরে সরকারের প্রচেষ্টায় গ্রামাঞ্চলেও বিদ্যুৎ সহজলভ্য হওয়ার কারণে সৌরবিদ্যুতের চাহিদা কমতে শুরু করল। বিদ্যুৎ ও আইপিএস-নির্ভর হতে শুরু করে সবাই।
সৌরবিদ্যুতে একসময় সিলিং ফ্যান, রঙিন টেলিভিশন ও ফ্রিজ চালানো সম্ভব না হলেও বর্তমানে সৌরবিদ্যুতের উন্নত প্রযুক্তির কল্যাণে রঙিন টেলিভিশন, সিলিং ফ্যান ও ফ্রিজ চালানো সম্ভব হয়। সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে এয়ারকন্ডিশনিং ও ফ্রিজ চালানো ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল। সোলার প্যানেল প্রয়োজন হলেও টিভি, ফ্যান, লাইট, কম্পিউটার কিংবা মোবাইল চার্জ দেয়ার মতো প্রয়োজনীয় ব্যবহারের ক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুৎ অতুলনীয়। বর্তমানে শুধু গ্রামাঞ্চলেই নয়, শহরেও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকারের আইন মোতাবেক ঢাকায় নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে হলে ভবনের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার নির্দিষ্ট পরিমাণ ‘সোলার সিস্টেম’ দিয়ে পূরণ করতে হবে। আবাসিক ভবনের জন্য তিন শতাংশ, বাণিজ্যিক ভবনের ক্ষেত্রে তিন থেকে আট শতাংশ এবং শিল্পকারখানার ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ আসতে হবে সোলার সিস্টেম থেকে।
সরকার দেশব্যাপী শতভাগ বিদ্যুতায়ন ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ঘোষণা দিলেও বিশ্ব রাজনীতির অস্থিরতা ও বিদ্যুৎ প্রকল্পে খরচের তুলনায় আয় কম হওয়া এবং বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য এলাকাভিত্তিক দৈনিক লোডশেডিং, রাত ৮টায় দোকান-মার্কেট বন্ধ করাসহ বিদ্যুৎ ব্যবহারে অপচয়রোধের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে বিদ্যুতের মূল্যও বৃদ্ধি করা হয়েছে। লোডশেডিংয়ের কারণে স্বাভাবিক কাজকর্মে বিঘœ সৃষ্টি হওয়া ছাড়াও গরমের মৌসুমে সীমাহীন দুর্ভোগে পতিত হতে হয় নাগরিকদের। বিদ্যুৎ নিয়ে দেশব্যাপী এই অস্থিরতার মাঝে নিরবচ্ছিন্ন সৌরবিদ্যুতের মাঝেই আস্থা খুঁজছেন অনেকে। বিদ্যুৎ সংযোগ বহাল রেখেও সৌরবিদ্যুতের ব্যবহারক্রমে বিদ্যুতের হয়রানি ও অধিক খরচ থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে ইলেকট্রিক হিটার ব্যবহার করে রান্নার কাজও সারা যায়। সেচ কার্যক্রমেও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করা যায়। মাটির চুলায় রান্নার কাজে লাকড়ির প্রয়োজন হওয়ায় গাছপালা কাটার মাধ্যমে পরিবেশের যে ক্ষতিসাধন করা হয়, তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সৌরবিদ্যুতে ব্যবহার-উপযোগী চুলা নির্মাণ করা দরকার।
পরিবেশবান্ধব সৌরবিদ্যুৎ একবার খরচ করে স্থাপনের পর পরবর্তী সময়ে শুধু রক্ষণাবেক্ষণের খরচ দিয়েই বছরের পর বছর ব্যবহার করা যায়। সৌরবিদ্যুৎ প্রাকৃতিকভাবে নবায়নযোগ্য হওয়ায় উৎপাদন নিয়ে বিচলিত হতে হয় না। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। স্রেডা ও ইউএনডিপির গবেষণা প্রতিবেদনমতে, ‘জমিস্বল্পতা স্বত্বেও সৌরবিদ্যুতায়নের আওতায় ২০৪১ সালের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। একটি উচ্চ ক্ষমতার সৌর স্থাপনা মডেলে এই সক্ষমতা ৩০ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। ছোট ও মাঝারি আইপিপি সৌরশক্তি কেন্দ্র, ইউটিলিটি সোলার, এপিজেড-এসইপিজেড, শিল্পছাদ-অফিস-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মিনি সৌর গ্রিড, সেচ, সোলার হোম, সোলার চার্জিং স্টেশন, কাপ্তাই লেক, ডেলটা প্ল্যান, যমুনা-পদ্মা-তিস্তা-মেঘনা রিভার বেসিন রিস্টোরেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের ভূমি, হাওর এবং উপকূলকেন্দ্রিক সমন্বিত সৌর মহাপ্রকল্প নিয়ে এটা করা সম্ভব।’
সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে সরকারি সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি করে বিদেশ থেকে অধিক মূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয় এবং তা ভর্তুকি দিয়ে বিক্রির বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। সেইসঙ্গে নাগরিকদের নিজ উদ্যোগে প্রয়োজনীয় কাজে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়ার লক্ষ্যে এককালীন খরচ করে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। পরিবেশবান্ধব সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা এখন সময়ের দাবি।
শিক্ষার্থী
ডিপ্লোমা ইন জার্নালিজম
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া (বিজেম)
কাঁটাবন, ঢাকা